করোনা: আক্রান্তের ক্ষত, মৃত্যুর ক্ষতি, ভয়জনিত আতঙ্ক

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 19:53:54

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে শুরু। বেশ কিছুদিন চেপে থাকার পর ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের করোনায় মৃত্যুর খবর জানাল চীন। ১৩ জানুয়ারি শোনা গেল থাইল্যান্ডেও করোনার আক্রমণ শুরু হয়েছে।

বিশ্বের শীর্ষ করোনা-বিপর্যস্ত দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত মানুষ মারা যায় ২৯ ফেব্রুয়ারি। ১১ মার্চ করোনাকে প্যানডেমিক বা বিশ্বব্যাপী মহামারির স্বীকৃতি দেয় ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (হু)।

মার্চ মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের কম। তখনও ইউরোপ ও এশিয়ার কিয়দংশ থেকে অবাধে মানুষ আসা-যাওয়া করছে। ওদিকে ছাত্রছাত্রীদের স্প্রিং ব্রেক। পার্টি চলছে। অঢেল মেশামেশা। ফলে করোনা ছড়াল ব্যাপক গতিতে।

এপ্রিল পেরুতেই সেই পঞ্চাশ হল পাঁচ হাজার। আর পরে তা প্রায় পঁচিশ হাজার স্পর্শ করে। সব থেকে বেশি মৃত্যু হয় নিউইয়র্কে। বেশিরভাগ পীড়িত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা, যাদেরকে খাবার বিলি করা হয়েছে। চাকরিহীন, গৃহহীনদের জন্য দেওয়া হয়েছে সাহায্য। দুই ট্রিলিয়ন (এক লক্ষ কোটি) ডলারের 'করোনা ভাইরাস এড প্যাকেজ' পাশ হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ ও ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা কিছুটা আর্থিক স্বস্তি পেয়েছে। এরই মাঝে এসেছে ভ্যাকসিন।  মহামারির বিরুদ্ধে চলমান প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের গতি বহুলাংশে চলে এসেছে মানুষের পক্ষে।

মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) পর্যন্ত জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুযায়ী সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত: ২৩৮,৩৪৬,৮৪৭ আর মৃত্যু: ৪,৮৫৯,১১২ জন। বাংলাদেশ আইইডিসিআর'র সূত্র মতে আক্রান্ত: ১৫,৬৩,৫০১ এবং মৃত্যু: ২৭,৭১৩ জন। সামনের ডিসেম্বর মাসে করোনা মহামারি বিস্তারের দুই বছর পূর্তিতে সংখ্যাটি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জোনাথন কুইক, একজন আমেরিকান চিকিৎসক, মহামারীর প্রকোপ, তার প্রতিকারের উপায় সংক্রান্ত পঠনপাঠন ও বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষ। ২০১৯ সালে বেরিয়েছে তাঁর বই (সহলেখক ব্রনউইন ফ্রায়ার) ‘দি এন্ড এফ এপিডেমিকস: দ্য লুমিং থ্রেট টু হিউম্যানিটি অ্যান্ড হাউ টু স্টপ ইট’। তিনি লিখছেন, ‘‘মরতে ভয় পাই আমরা সকলেই। এপিডেমিকের ভয়ে উদ্বেল আমরা অন্য কারও ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাই। যখনই কোনও আশঙ্কার মুখে পড়ি, তখনই দোষের ভাগীদার হয় ওই ‘ওরা’, যাদের ঠিক ‘আমরা’ বলে আমরা মনে করি না। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু দেখা দিলে আমেরিকানরা ‘হুন’দের [অর্থাৎ জার্মান] দায়ী করেছিল। এইডস রোগের দায় চেপেছিল সমকামীদের ওপর। যারা রোগাক্রান্ত, তাদেরই সাজা দেবার এক উদগ্র আগ্রহ চেপে বসে সকলের মনে করা হয়, তাদের অন্যরকম হওয়াটাই এই রোগশাপ লাগার কারণ। সবথেকে সংক্রামক যেটা, যেটা রাজনৈতিক নেতা, বণিকমহল, সাধারণ মানুষকে আসল রোগটার থেকেও মাত্রাছাড়া বেশি আক্রমণ করে সেটা হল আতঙ্ক। প্যানিক। আতঙ্কিত মানুষ সংবাদগুলোর ভেতর মাত্রাতিরিক্তভাবে নিজেকে আরোপ করে, তাদের উদ্বেগ পাল্লা দিয়ে বাড়ে। আতঙ্ক আসলে একটা খবরদারির ব্যবস্থা, যেটা আমাদের সম্ভাব্য বিপদ সম্বন্ধে সজাগ রাখে, যেমনটা করে কোনও পশুর ক্ষেত্রেও। আমরা যখনই এটাকে আমাদের যুক্তিবোধকেও ছাপিয়ে উঠতে দিই, ব্যাপারটা বেশি করে ঘেঁটে যায়।’’

সকলে একরকম নন। ‘দ্য সাইকোলজি অফ প্যানডেমিকস: প্রিপেয়ারিং ফর দ্য নেক্সট গ্লোবাল আউটব্রেক অফ ইনফেকশাস ডিজিজ’ বইতে (প্রকাশকাল: ২০১৯) মনস্তত্ত্ববিদ স্টিভেন টেলর অন্য রকম লিখছেন: "অনেক মানুষই মানসিক ঘাত সামলে নিতে পারেন, প্রচণ্ড মানসিক চাপে ফেলা ঘটনাও অনেকেই পেরিয়ে যান, তাদের মনে কোনও স্থায়ী ছাপ থাকে না তার। কিন্তু আগামী প্যানডেমিকে বহু মানুষ যে আতঙ্কিত হয়ে পড়বে, কারও কারও মধ্যে তার মাত্রা হবে অত্যন্ত বেশি এটা একরকম নিশ্চিত। মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত  বা সাইকোলজিকাল ‘ফুটপ্রিন্ট’, ব্যাধিঘটিত ক্ষতর তুলনায় বেশি হবে।"

২০১৪-১৫ সময়কালে ইবোলার পাশাপাশি পশ্চিম আফ্রিকায় যেটা ঘটেছিল সেটা ‘এপিডেমিক অফ ফিয়ার’, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার সঙ্গে উদ্ভূত আতঙ্কের মাত্রার মিল ছিল না। আতঙ্কিত হয়েছিল আমেরিকাও, যদিও সেখানে সংক্রমণের সম্ভাবনা ছিল খুবই কম বা নগণ্য।

করোনা কেটে যাবে একদিন, যেমন বিদূরিত হয়েছে অতীতের বহু মহামারি। কিন্তু আক্রান্তের ক্ষত, মৃত্যুর ক্ষতি, ভয়জনিত আতঙ্ক মানুষের জীবন ও মন থেকে খুব সহজে কাটবে না। মানুষের জীবন ও যাপন নিঃসন্দেহে বদলে যাবে 'করোনার-আগে' এবং 'করোনার-পরে' নামক সুস্পষ্ট বিভাজনে। এসব কথা বলা যায় করোনা মহামারির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্বে প্রতিনিয়ত যে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা হচ্ছে, তার আলোকে। এসব বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে গবেষণায়। এর মধ্যে রয়েছে করোনার কারণে আর্থিক লাভ-ক্ষতির খতিয়ান, রয়েছে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু, মানসিক প্রসঙ্গও। গবেষকরা এমনও বলেছেন যে, 'বিশ্বব্যাপী কোভিডের কারণে মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে।'

করোনাকে নিয়ে এতো ভাবণা ও গবেষণা অহেতুক হচ্ছে না। কারণ অতীতের বিভিন্ন বৈশ্বিক মহামারির মৃত্যু সংখ্যাকে এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হিসাব। আক্রান্ত হয়ে পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ভুগছেন লক্ষ-কোটি মানুষ। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম ব্যাপক হারে কমেছে মানুষের গড় আয়ু।

গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য পাওয়া গেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, করোনায় বিশ্বে শীর্ষ আক্রান্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের গড় আয়ু কমেছে প্রায় দুই বছর। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান দেশগুলো এবং দক্ষিণ আমেরিকার একাধিক দেশে কোভিডের প্রভাবে কমে গেছে গড় আয়ু।

মোট ২৯টি দেশে সমীক্ষা চালিয়েছিল অক্সফোর্ড। তাতে ২২টি দেশ থেকেই আয়ু হ্রাসের এই দাবির স্বপক্ষে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকগণ।  ২০১৯ সালের সঙ্গে  তুলনামূলক বিচারে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালে করোনার প্রকোপে মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এদিকে, প্রায় ২ বছর ধরে করোনার সঙ্গে লড়ছে গোটা বিশ্ব। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দক্ষিণ এশিয়ায়ও করোনার জোরালো দাপট বিদ্যমান। মাঝে মাঝেই করেনার নতুন ঢেউ আর ভাইরাসের নতুন নতুন প্রজাতি থাবা বসাচ্ছে সারা বিশ্বেই। তবে আশার কথা হলো, গত দু’বছর ধরে করোনার সঙ্গে লড়তে-লড়তে বহু মানুষের শরীরেই তৈরি হয়েছে অ্যান্টিবডি। সেই অ্যান্টিবডি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। টিকা বিশেষ সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করছে করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে।

পৃথিবী ও মানব সভ্যতার ইতিহাসে একবিংশ শতাব্দীতে ছড়িয়ে যাওয়া সবচেয়ে ব্যাপক ও হন্তারক বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে,সমাজ ও নাগরিক জীবনের গতিপ্রকৃতি। পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের সামাজিকতার ধরন। হঠাৎ করেই সব মানুষ ঘরবন্দী হওয়ায় জনশূন্য পথঘাট যেমন হাহাকার করেছে, তেমনি জীবন-যাপনেও এসেছে বহুবিধ সতর্কতা। মার্কেট প্লেস, মুখরিত থাকা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে গুটিকয় লোকের আনাগোনায় ভূতুড়ে মনে হচ্ছে প্রায়ই। নিস্তব্ধ বা আদা-জীবন্ত হয়ে আছে বহু নগরী। পেশা হারিয়েছেন বা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বহু দেশেই শোনা গেছে আর্থিক মন্দার পদধ্বনি।

করোনা বিশ্ববাসীকে অনেক কিছু শিখতে বাধ্য করেছে। বদলে দিয়েছে চালচলন ও দৈনন্দিন জীবনের হালচাল। ইউরোপে ছেলেরা হ্যান্ডশেকের বদলে এখন পায়ে–পায়ে বাড়ি দিয়ে সম্ভাষণ জানায় একে অপরকে। নারীদের গালে গাল লাগিয়ে সম্ভাষণের যে রেওয়াজ চালু ছিল, তা-ও সম্ভবত একদমই বন্ধ হয়ে যাবে। সামাজিক মেলামেশা, আড্ডা, হৈচৈ, ভ্রমণ, পরিবহণ ইত্যাদিতেও এসেছে ব্যাপক রূপান্তরও নিয়ন্ত্রণ।

পৃথিবী থেকে করোনা একসময় বিদায় নেবে, কিন্তু সামাজিকভাবে অনেক প্রচলিত আচরণ হয়তো মানুষ একেবারেই ভুলে যাবে। মাস্ক ও স্যানিটাইজার হয়ে দাঁড়াবে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রধান আইটেম। করোনার জের টানবে বহু মানুষ। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হবে বহু পরিবার। ক্ষয়-ক্ষতি পোষাতে নাভিশ্বাস উঠবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। সবচেয়ে বড় কথা, করোনায় স্থবির বন্দি বছরগুলো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। করোনায় কমে যাওয়া মানুষের গড় আয়ুও হয়তো খুব সহজে আবার বৃদ্ধি পাবে না। বস্তুতপক্ষে,  পৃথিবী ও মানুষের জীবন স্পষ্টভাবে বিভাজিত ও পার্থক্যযুক্ত হয়ে যাবে 'করোনার আগে' এবং 'করোনার পরে' শিরোনামে, যার রেশ থেকে যাবে করোনায় আক্রান্তের ক্ষত, মৃত্যুর ক্ষতি, ভয়জনিত আতঙ্কের প্রহরে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর