সুবচন নির্বাচনে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:06:03

‘সুবচন নির্বাসনে’। আবদুল্লাহ আল মামুনের একটি বিখ্যাত নাটক। নাটকের পটভূমি দেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা স্কুল শিক্ষক। ছেলে খোকন, তপন ও মেয়ে রানু নিয়েই তার পরিবার। স্কুল মাস্টার বাবা বাঙালি সমাজে প্রচলিত চিরন্তন কিছু সুবচনে বিশ্বাস করেন। আর তিনি চান-তার ছেলে-মেয়েরাও যেনো ওই সব আদর্শেই বড় হয়। বাবা বিশ্বাস করেন-‘সততাই মহৎ গুণ’, ‘লেখাপড়া করে যে- গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’,...ইত্যাদি ইত্যাদি।

বড় ছেলে খোকন চেষ্টা করেছে বাবার আদর্শেই চলতে। কিন্তু সমাজে চলতে গিয়ে পদে-পদে সে হোঁচট খেয়েছে। পড়াশোনা, চাকরি, সামাজিক জীবন-সবক্ষেত্রেই সে দেখেছে বাবার শিখিয়ে দেয়া আদর্শের পরাজয়। স্বাধীনতার পর এভাবেই দেশ থেকে ধীরে ধীরে সুবচন নির্বাসনে গিয়েছে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে আদর্শহীনতা, নীতিহীনতা, কপটতা, ভণ্ডামি ইত্যাদি। আমাদের বর্তমান সমাজ, সংসার, পরিবার, রাষ্ট্র-সব ক্ষেত্র থেকেই সুবচন আজ নির্বাসনে। বিষয়টি আরো বেশি দৃশ্যমান আমাদের রাজনীতিতে।

রাজনীতিতে একটি কথা বলা হয়-ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। এখন দলই শেষ কথা। এক দলের রাজনীতিক আরেক দলের রাজনীতিকদের যা খুশি তাই বলতে পারেন। অপর দলের রাজনীতিক যতো সিনিয়রই হোন না কেন, তাকে যতো বেশি গাল-মন্দ করা যায়, নিজ দলে অবস্থান ততোই পাকা-পোক্ত হয়। এখন মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। সংলাপতো অনেক পরের কথা। যদিও ইতোমধ্যেই গণভবনে আগামীকাল একটি সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। এটি শুভ দিক। কিন্তু হালের রাজনীতিতে চলছে চরিত্রহনন পর্ব। এমন একটি প্রেক্ষাপটেই দিন দুই আগে প্রথম আলো অনলাইনে মহিউদ্দিন আহমদের একটি লেখা পড়লাম। শিরোনাম সেই ‘সুবচন নির্বাসনে’। আমরাও একমত। দেশের রাজনীতির চালচিত্র দেখে যে কারো মনে হতেই পারে-সুবচন আজ নির্বাসনে। কিন্তু আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করেও কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করতে চাই। সুবচন সমাজ-রাষ্ট্র থেকে পুরোপুরি নির্বাসিত হলেও নির্বাচনের আগে আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে বিরাজ করে সুবচনের সুবাতাস। তাই ওপরের ওই শিরোনাম-‘সুবচন নির্বাচনে’।সুবচন শুধুই নির্বাচনে।

নির্বাচনের আগে রাজনীতির ময়দানে রীতিমতো সুবচনের রেওয়াজ চলতে থাকে। এতোদিন যারা আ-কথা, কু-কথা বলে মাঠ গরম করেছেন, নির্বাচনের আগে তারাই ভালো কথার মহড়া দিচ্ছেন। হয়তো এটিই রাজনৈতিক আদব। রাজনীতির এ আদব-লেহাজ শুধু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেই দৃশ্যমান; তা নয়। সামরিক শাসকদের রাজনীতিতে অভিষেকের সময়ও দেখা যায় সুবচনের মহড়া। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর একদিন পরেই জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘দেশের জনগণের অধিকার সুনিশ্চিতভাবে পুন:প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে...আমি ও আমার সরকার পূর্ণ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং যথাসময়ে জনগণের নির্বাচিত সরকার পুন:প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ।’ কিন্তু তার সময়ে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? অথবা জনগণের নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়েছে কি? কাজেই নির্বাচেনর আগে এরকম সুবচনের মহড়া নতুন কিছু নয়।    

সংবিধানে আছে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরাই এ কথা বলেন। অন্যান্য সভা-সমাবেশেও বলেন, কিন্তু নির্বাচনের আগে এটিই হয় তাদের প্রধান বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভোটটা দেয়া পর্যন্ত বা বড়জোড় ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে কোনো রকম জনগণকে তোয়াজ করে চলা আর কি! ফল ঘোষণার পরেই জয়ীরা হয়ে যান মহোদয়-এমপি মহোদয়, চেয়ারম্যান মহোদয় ইত্যাদি। আর পরাজিতরা হয়ে যান উধাও। এই মহোদয়রা তাদের মেয়াদকালে জনগণের কথা বেমালুম ভুলে যান। কিন্তু নির্বাচনের আগে মহোদয়দের আবার বোধোদয় হয়। 

বলছিলাম জিয়াউর রহমানের কথা। একদিকে জনগণকে সুবচন শুনিয়েছেন আর অন্যদিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতেও ছুড়ি চালিয়েছেন। সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলেছেন। কাজেই সুবচনের আড়ালের গোপন কথা জনগণ হয়তো কোনোদিনই শুনতে পাবে না।

এসব নির্বাচনী সুবচনের একটিই উদ্দেশ্য-কোনো মতে ভোটের দিনটা পর্যন্ত রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাই জনগণকে তোয়াজ-তমিজ করে নানা রকম আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। জনগণ জানে ওসব কিছু নয়, কিন্তু তারপরও তাদের আশ্বাসেই বিশ্বাস করতে চায়।

নির্বাচন যার যার (প্রার্থীর বা দলের), ভোট সবার। এখন হয়েছে নির্বাচন যার ভোটও তার। নির্বাচন কার? ক্ষমতা যার। তার মানে দাঁড়ালো-ক্ষমতা যার ভোটও তার। সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলের ম্যান্ডেট নিয়ে আমাদের বাপ-দাদারা বাংলাদেশ স্বাধীন করলো। কিন্তু আমরা তাদের সন্তান-নাতি-পুতিরা একপক্ষ আরেক পক্ষকে ‘সাগড় চুরি’ ‘পুকুর চুরি’র অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ করে যাচ্ছি স্বাধীনতার পয়তাল্লিশ বছর পরেও।

এই অভিযোগের দায় থেকে মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার জন্য আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত গদি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।  যেদিন খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছাড়েন সেদিনই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি জাতিকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সেদিন তিনি জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া এবং নিরাপদে যাতে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করাই ছিল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। জনগণ সেদিন এ উদ্দেশ্যেই রাজপথে নেমেছিল। জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল বলেই সেদিন আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল-রাজপথের আন্দোলনে ও ভোটের রাজনীতিতে। ’৯৬-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তাই, দেশের এই সংকটময় মুহুর্তে জনগণের প্রতি আমার আহবান, কোনো অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার যেকোনো অপচেষ্টা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব।’ নাগরিকরা তাদের সে দায়িত্ব পালন করেছে। তারা আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা প্রদর্শন করেছে। আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছে। স্বাধীনতার পরে এতো বড় বিজয় আওয়ামী লীগের আর জোটেনি।  ’৯৬-এ জনগণ আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনে। ২০০৮-এর নির্বাচনেও জনগণ আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতিভূ হিসেবে। দিন বদলের সনদের ওপর জনগণ আস্থা রেখেছে। দিনবদলের সুবচনে বিশ্বাস করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জনগণের ওপরেই আস্থা রেখেছেন। এই সংসদের শেষ অধিবেশনেও তিনি এ কথা জোড় দিয়েই বলেছেন। জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, রাষ্ট্রক্ষমতারও মালিক। একথা জনগণ জানে, মানে, কিন্তু বিশ্বাস করতে ভয় পায়।

রাজনীতিতে হঠাৎ সংলাপ-সমঝোতার আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতিকরা, ভোটপ্রার্থীরা ভালো ভালো কথা বলতে শুরু করেছেন।নির্বাচনের আগে এমন হয় আমরা জানি। কিন্তু আশা করতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই-এরকম সংলাপ-সমঝোতা-সুবচন বিরাজ করুক সব সময়। 

এরশাদুল আলম প্রিন্স: আইনজীবী, কলামিস্ট ও কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর