আজ কার বৃহস্পতি তুঙ্গে?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-26 06:37:25

সকলের অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি অর্থবহ সংলাপের তাগিদ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহবায়ক ড. কামাল হোসেন। সেই লক্ষ্যে শেখ হাসিনার কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগেই ৭ দফা ঘোষণা করেছে। চিঠিতে ৭ দফা ও ১১ লক্ষ্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। চিঠি পাঠানোর ২০ ঘণ্টার মধ্যে শেখ হাসিনার ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন, একদিনের মধ্যে পেয়েছেন দিনক্ষণ উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিক চিঠি।

ড. কামাল তার চিঠিতে ৭ দফার কথা উল্লেখ করলেও শেখ হাসিনার সাড়া নিঃশর্ত। শেখ হাসিনা বলেছেন, 'গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য আমার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত।' এখন দেখার বিষয় ৭ দফার সাথে সংবিধানের বিরোধ কতটুকু। ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা নাকি শেখ হাসিনার সংবিধানসম্মত বিষয়; আলোচনার টেবিলে কোন বিষয়টি এগিয়ে থাকে। বৃহস্পিতবার সন্ধ্যায় কার বৃহস্পতি তুঙ্গে ওঠে?

নাটকীয়ভাবে শেখ হাসিনা রাজনীতিকে সংলাপের টেবিলে নিয়ে যাওয়ার আগে আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার বলছিলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা সংবিধান পরিপন্থী। এর একটিও মানার সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের এ দাবি ঠিক নয়। ৭ দফার অন্তত ৬টির সাথে সংবিধানের কোনো সম্পর্ক নেই। একটু আন্তরিকতা থাকলেই এগুলো পূরণ করা সম্ভব। সংলাপকে সামনে রেখে চলুন দেখে আসি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফায় কী আছে? তার কতটা, কীভাবে পূরণ করা সম্ভব?

চলুন আমরা নিচ থেকে দেখে আসি:

৭ নাম্বার দফা হলো, নির্বাচন পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও কোনো ধরনের নতুন মামলা না দেওয়া। আমার ধারণা, রাজনৈতিক মামলা করার অভিযোগ স্বীকারই করবে না। তারা বলবে, যা মামলা হয়েছে সবই সত্য। কিন্তু সরকারের এ দাবি সত্য নয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে গত দুই মাসে অন্তত ৪ হাজার মামলা হয়েছে। যাতে তালিকা ধরে ধরে বিরোধী দলের সম্ভাব্য এজেন্ট ও সক্রিয় নেতাদের আসামি করা হয়েছে। এসব মামলাকে পত্রিকায় লেখা হচ্ছে 'গায়েবী মামলা'। কারণ এসব মামলার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনাই ঘটেনি বা আসামি করা হয়েছে বিদেশে থাকা, হজে থাকা, কারাগারে থাকা, এমনকি মারা যাওয়া মানুষকেও।

নতুন মামলা না দেয়ার বিষয়ে হয়তো সরকারি দল শুরুতেই রাজি হয়ে যাবে। কারণ গত দুই মাসে যা মামলা দেয়া হয়েছে, তাতে আর নতুন মামলা না দিলেও চলবে। তবে পুরোনো মামলা স্থগিত করাতে সরকারি দলকে রাজি করানো সহজ হবে না। তবে সদিচ্ছা থাকলে এটা মেনে নেয়া অসম্ভব নয়।

৬ নাম্বার দাবিটি মানতে এক সেকেন্ডও লাগবে না। নির্বাচনের সময় দেশি- বিদেশী পর্যবেক্ষক নিয়োগ এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর যে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করার দাবির সাথে একমত হবেন না; এমন কে আছেন?

৫ নাম্বার দফা তেমন সমস্যা হবে না মনে হয়। ঐক্যফ্রন্ট চাইছে নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকুক। এই ক্ষমতা সব কমিশনেরই থাকে। কমিশনের কোমরে জোর থাকে না বলে তারা সে ক্ষমতা পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারেন না। আমার ধারণা আগামী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে। তবে সেটা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ নাকি আগের মত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেটা নিয়ে রশি টানাটানি চলতে পারে সংলাপের টেবিলে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হলেও আমি অবাক হবো না। তবে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত কিন্তু সরকারের নয়, নির্বাচন কমিশনের।

৪ নাম্বার দাবি আসলে প্রায় পূরণ হয়ে গেছে। এক শহীদুল আলম ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নানা আন্দোলনে গ্রেপ্তার করা সবাইকেই মুক্তি দেয়া হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে নির্বাচনের আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইন বাতিলের কোনো সম্ভাবনা নেই।

৩ নাম্বার দাবি মানতেও সময় লাগবে না। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিত করার দাবি কে মানবেন না? তবে প্রচার-প্রচারণায় সরকারি দল যতটা এগিয়ে আছে, এখন ফিল্ড যতই লেভেল হোক; ঐক্যফ্রন্ট আর তাদের ধরতে পারবে না।

২ নাম্বার দাবি আংশিক পুরণ করা যেতে পারে। যদিও আরপিও সংশোধন করে আগামী নির্বাচন ইভিএম ব্যবহারে সুযোগ রাখা হয়েছে; কিন্তু এটা বাধ্যতামূলক নয়। নির্বাচন কমিশন চাইলে ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করতে পারে, আবার একদম নাও করতে পারে বা সীমিত আকারে করতে পারে। আমার ধারণা ইভিএম নিয়ে আলোচনা আটকাবে না। এটা কোনো বড় ইস্যু নয়।

তবে জট লাগবে ১ নাম্বার দাবি নিয়ে। সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি সরকার কোনোভাবেই মানবে না। এখন আর সেই সময়ও নেই। আর এই দাবি সংবিধানসম্মতও নয়। এটা ঠিক বিষয়গুলো বর্তমান সরকারই সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেছে।

আর ড. কামাল যেমন বলছেন, চাইলে এক মিনিটে সংবিধান সংশোধন সম্ভব, এটাও ঠিক। কিন্তু সরকারি দল এখন এই দাবি মানার অবস্থায় আছে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। তবে নির্দলীয় না হলেও একটা সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার হতেই পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তখনকার বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সরকার তো দূরের কথা নির্বাচনেই অংশ নেয়নি।

এবার প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার হবে। তবে চাইলে সংবিধানসম্মত ভাবেই টেকনোক্র্যাট কোটায় ঐক্যফ্রন্টের ৪/৫ জনকে মন্ত্রিসভায় নেয়া সম্ভব। তেমন কোনো চমক এলে আমি অন্তত চমকিত হবো না। তবে বিএনপি একটা জায়গা এসে গিট্টু লাগিয়ে দেবে। তাদের 'ওয়ান অ্যান্ড অনলি' দাবি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যেতে চাইবে না। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে ড. কামাল হোসেনের মুখ বন্ধ করতে শেখ হাসিনার এক মিনিট লাগবে। তিনি যদি বলেরন, চাচা দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, যার একটি আবার আপিলে এসে সাজা না কমে ডাবল হয়েছে, তার মুক্তি আমি কিভাবে দেবো? আইনজীবী হিসেবে তো আপনি বুঝবেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেই, এটা আদালতের এখতিয়ার। তখন ড. কামাল কী বলবেন? আলোচনার পরিবেশ খুব ভালো থাকলে, সরকারি দলের সর্বোচ্চ সদিচ্ছা থাকলে বেগম জিয়াকে তার পছন্দের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে বা গুলশানের বাসাকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে তাকে রাখা হতে পারে।

তবে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং বেগম জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন না; এছাড়া বাকি সব দাবি মেনে নিলেও কি ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে? আমার ধারণা ঐক্যফ্রন্ট যাবে, তবে বেগম জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যেতে চাইবে না। তবে না চাইলেও এবার অস্তিত্বের স্বার্থে তাদের যেতেই হবে। কারণ সরকারি দল যখন বলবে, ৭ দফার মধ্যে ৫টি পুরোপুরি এবং বাকি দুটি আংশিক মানা হয়েছে; তারপরও তারা নির্বাচনে আসছে না; তখন দেশি-বিদেশি উদ্বিগ্ন মহল কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপিকেই দুষবে। তখন তারা গ্যাড়াকলে পড়বে ভালো করে।

লেখায় আমি শুধু ৭ দফা মানার সম্ভাব্যতা যাচাই করলাম। তবে আলোচনার টেবিলে নির্ধারিত হবে কে, কতটুকু ছাড় দেবে। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে কে কতটা আদায় করতে পারবে তার ওপর। সংলাপ আসলে একটা মাইন্ড গেম, দাবা খেলার মত। একটা ভুল চালেই আপনি হেরে যেতে পারেন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কার বৃহস্পতি তুঙ্গে ওঠে, সেটা দেখতে গোটা জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

সর্বশেষ: জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের গণভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি আব্দুস সোবহান গোলাপকে বলেছিলেন, দাওয়াত দিতে গিয়ে যেন ড. কামাল কী খাবেন, সেই মেন্যুটাও জেনে আসেন। ড. কামাল নাকি সেদিন শুধু চিজ কেকের কথা বলেছিলেন। সেই চিজ কেক তো থাকছেই। সাথে আরো ১৬ আইটেমের নামের তালিকা অনেকের জিভেই জল এনেছিল। কিন্তু সংলাপের আগের রাতে ঐক্যফ্রন্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা সংলাপে যাবে, তবে খাবেন না। তারা বলছেন, তারা আলোচনা করতে যাচ্ছেন, খেয়ে সময় নষ্ট করতে নয়।

কিন্তু তাদের আমন্ত্রণে শুরুর সময় উল্লেখ থাকলেও শেষের সময় নেই। তারা ৫ ঘণ্টা আলোচনা করে খেতে বসলে তো আর শেখ হাসিনা তাদের তুলে দেবেন না। চাইলে তারা শুরুতে খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে পারেন। দাওয়াতে যাবো, কিন্তু খাবো না; এটা হাস্যকর ছেলেমানুষি। তবে এটা ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান নয়। বেগম জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নেতারা গণভবনে খেতে চান না। এই অবস্থানটাই তারা ঐক্যফ্রন্টের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আর ঐক্যফ্রন্ট সময় নষ্টের অজুহাত দিয়ে তা ঘোষণা করেছে। এই লেখায় অনেক যদি, কিন্তু, হতে পারে, ধারণা আছে। তবে একটা কথা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি; দাবি মানুন আর না মানুন; শেখ হাসিনা কাউকে না খাইয়ে ছাড়বেন না। তিনি পাতে তুলে তুলে পেটপুড়ে খাওয়াবেন। তাঁর আতিথেয়তার অনেক সুনাম আছে।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর