দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া…

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-23 04:43:07

সদ্য সমাপ্ত পুজার সময়ে কলকাতায় যেতে চেয়েও যাওয়া হয়নি। যাদের সঙ্গে কাজ, তারা সবাই পুজার ছুটিতে বেড়াতে যাবেন। ইউরোপ-আমেরিকাতেও বিভিন্ন ছুটি আর উইকঅ্যান্ডে লোকজনকে পাওয়া যায় না; সবাই বেড়াতে চলে যান পাহাড়, বন কিংবা সমুদ্রে। কবির ভাষায়, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘরের বাহিরে দুই পা ফেলিয়া’, কথাটি সকলের ক্ষেত্রে সত্যি নয়।

বাংলাদেশেও এসে গেছে বেড়ানোর সময়। মূলত শীতকালে পিকনিক বা ট্যুরে বের হয় এখানকার মানুষ। যদিও তা সংখ্যা বা পরিমাণের দিক থেকে খুব বেশি নয়।

ইউরোপ-আমেরিকা, এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতেও বেড়ানোর যে হিড়িক তা রীতিমত উৎসবের মতো। কলকাতায় কয়েকটি পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যারা বছরের শুরুতে বইকেনা ও বেড়ানোর প্ল্যান করে রাখেন। তারপর এ দু’টি খাতে খরচের উদ্দেশ্যে অল্প অল্প করে আগাম টাকা জমান। সে টাকায় পুজার সময় দেশের একেকটি স্থানে চলে যান। এভাবে বিশাল ভারত তাদের দেখা হয়ে যায়। বাকী টাকায় সারা বছর পছন্দ করে রাখা বইগুলো ডিসেম্বরের বইমেলা থেকে কিনেন। এমন পারিবারিক পরিকল্পনা একটি-দুটি নয়, অসংখ্য পরিবারেই দেখতে পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশে এমন সুপরিকল্পিত ভ্রমণ বা বইকেনার রেওয়াজ এখনো হয়নি। আকস্মিকভাবে টানাটানির কারণে মানুষ ভ্রমণ করেন এখানে। পাড়া বা স্কুল-কলেজ থেকে ডাকাডাকি করলেই অগত্য মাঝে মাঝে কেউ কেউ তাতে অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীরাও মূলত শিক্ষার্থী, তরুণ, যুবক। সারা বছর ধরে প্ল্যান করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার কালচার এদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে বিদেশ তো বটেই, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও নান্দনিক সৌন্দর্যের সবটুকুও দেখা হয় না অনেকেরই।

আজকাল অবশ্য ট্র্যাভেল মেলা হচ্ছে, বিভিন্ন বিমান কোম্পানি নানা রকমের ভ্রমণ প্যাকেজ দিচ্ছে। তারপরেও ভ্রমণকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করে সেদিনে নজর দেওয়া হচ্ছে না। মানুষ মূলত ঘরকোণো, আড়ষ্ঠ, আটপৌরে ও গতানুগতিক জীবনের ঘেরাটোপেই বন্দি হয়ে থাকছে।

ভ্রমণ সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়ার পেছনে যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, দুর্ভোগ, বিড়ম্বনার কথা বলেন অনেকে। অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকায় ভ্রামণিককে বাস, ট্রেনের টিকেট কাটা, থাকা-খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি সকল কাজই একাকী করতে হয়। সবকিছু নিজে নিজে করতে গিয়ে নানা হেনস্তার শিকারও হতে হয় ভ্রমণাগ্রহীদের। এসব কষ্ট মেনে কতজনই আর বাড়ির বাইরে যেতে চান!

ভারতের মতো নেপালেও দেখেছি ভ্রমণের অবারিত সুযোগ। ব্যক্তিগত ও সরকারি নানা কোম্পানি হাজার রকম প্যাকেজ সাজিয়ে বসে আছে। মানুষ তার সময় ও সুযোগমতো একটিকে বেছে নিচ্ছে। কেউ সারা দিনের সাইট-সিয়িং ট্যুর নিচ্ছে তো কেউ পাঁচ বা সাত দিনের প্যাকেজে চলে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিকে ট্যুর প্রোগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে বছরব্যাপী চলছে নানা স্থানে থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের ভ্রমণ প্যাকেজ। অনেকেই জানুয়ারিতে বুকিং দিয়ে প্রতিমাসে অল্প অল্প টাকা কিস্তিতে জমা করে বছর শেষে বেশ ব্যয়বহুল কোনও ট্যুর সম্পন্ন করছেন। মানুষটি হয়ত নিম্ন বা মধ্য আয়ের, কিন্তু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা থাকায় কিস্তিতে কিস্তিতে দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতিতে তিনি বড় মাপের একটি ভ্রমণ ট্যুর করতে পারলেন।

বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবস্থার কথা শোনা বা জানা যায়নি। এখানে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ট্যুর কোম্পানিও গড়ে ওঠেনি। মাঝে মাঝে কোনও কোনও কোম্পানি মেলা বা প্রদর্শনীর মতো করে কিছু মানুষকে ভ্রমণে আগ্রহী করে ট্যুর করছেন বটে। তবে তাতে ভ্রমণের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিশেষ উন্নতি ও বিকাশ হচ্ছে বলে মনে হয় না।

ভ্রমণের ক্ষেত্রে অবকাঠানোর উন্নতি না হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। সরকার বা বেসরকারি খাত এ ব্যাপারে একেবারেই মনোযোগী নয়। দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসা নয়, মানুষের কাছ থেকে একবার কিছু টাকা হাতিয়ে নিতে পারলেই প্রতিষ্ঠানগুলো খুশি। এর বাস্তব প্রমাণ হলো হজ। হজ একটি ধর্মীয় ভ্রমণও বটে। হজের মৌসুমে বাহারী বিজ্ঞাপন দিয়ে ও দালাল লাগিয়ে লোক টানে কোম্পানিগুলো। তারপর শোনা যায় নানা বিড়ম্বনা ও অভিযোগ। কোনও হজ এজেন্সি পাওয়া যাবে না, যারা সার্ভিসের মান ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখতে পেরেছেন। ভ্রমণ এজেন্সির অবস্থা আরও খারাপ।

প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার অভাবে ভ্রমণের ইচ্ছা থাকলেও মানুষ থমকে আছেন। চক্ষু মেলে দেখতে পারছেন না বাংলাদেশের সবটুকু। সমুদ্র, পাহাড়, বন-বনানী, হাওর, বিল-ঝিল, নদী-নালার অপূর্ব বাংলাদেশ রয়ে যায় অদেখা। তবু কেউ কেউ একা বা ছোট্ট ছোট্ট গ্রুপে বের হন। ঘুরে দেখেন বাংলাদেশের সব কিছু। অনিন্দ্য সুন্দর মানুষ, প্রকৃতি ও নিসর্গের মাঝে খুঁজে পান প্রাণের বাংলাদেশ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর