ঘাটে ঘেঁষেও ডুবলো ফেরি -দায়ী কে?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-31 23:48:21

নদীর প্রবল ঢেউ পেরিয়ে এত বড় ও এত উঁচু একটি রোঁ রোঁ ফেরি ঘাটে ঘেঁষেও উল্টে গিয়ে ডুবে গেল! যা একটি অভিনব ও আশ্চর্য্য ঘটনা। এটা নদী পরিবহনের বারো দশার আরো একটি করুণ নমুনা। প্রায় ৪০ বছর আগে কেনা এই নৌযানটি সহ আরো অনেকগুলো অতিবৃদ্ধ নৌযান দেশের নদী-সাগরে প্রতিদিন চলাচল করছে। আইন ও নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে নদী, রেল, সড়ক সব পথেই এরকম হাজারো যানবাহন চলছে। সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসকল যানবাহনে চলাচল করছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ, শ্রমজীবি ও হতদরিদ্র মানুষেরা এসব যানবাহনের আর কোন বিকল্প খুঁজে পায় না। তাই পথে নেমে কোন যানবাহন ভাঙা, পুরনো, মেয়াদোত্তীর্ণ কি-না তা দেখার অবকাশ তাদের থাকে না। যারা নতুন গাড়ি কিনে ঈদে বা কোন অনুষ্ঠানে বাড়ি ফিরতে চান বা কোথাও যেতে চান তারাও এসব দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। এরই মাঝে হাৎ একদিন ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা। কিছুনি আগে লইছকা বিলে ট্রলারডুবিতে বহু প্রাণহানি হয়েছিল।

কোথাও কোনরূপ দুর্ঘটনা ঘটে গেলেই শুরু হয় নানা ‘ব্লেম-গেম’। এবার অনাকাঙ্ক্ষিত ও আকস্মিকভাবে রোঁ রোঁ ফেরিটি ঘাটে ঘেঁষেও উল্টে গিয়ে ডুবে যাবার ঘটনায় কে কাকে দোষারোপ করবে তা এখন দেখার বিষয়।

আমাদের নদীপথ চিরদিনই বিপদসংকুল। নদী ছাড়াও খাল-বিল-হাওড়-বাওড় সবজায়গায় নৌ দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে প্রায় প্রতিদিন। তবে এত পুরনো যানবাহন পৃথিবীর আর অন্য কোন দেশে গণপরিবহন হিেিসবে চলাচল করে কি-না সন্দেহ রয়েছে। কারণ, প্রতিবেশী ভারতেও কঠিনভাবে পরিবহন আইন মেনে চলা হয়। সেখানে পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে অনেক বড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয়। জাপানে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে একজনকে ১০ বার ফেল করে তারপর প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষায় পাশ করে লাইসেন্স পেতে শুনেছি। কারণ সেখানে পথে গাড়ি নিয়ে নামতে চাইলে ঘুষ প্রদানের কারবার নেই। সব কিছু মেকানাইজ্ড। গাড়িকে ফিটনেস টেস্ট করানো হয় মেশিনের মাধ্যমে, সাথে গাড়ির ড্রাইভারকেও মেডিকেল টেস্ট পাশ করতে হয়।

অপরদিকে আমাদের দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ রংচটা গাড়িকে রং লাগিয়ে রাস্তায় নামানো হয়। ইঞ্জিনের গায়ের নম্বর ঘঁষে আবার খোদাই করে চালানোর চেষ্টা করা হয়। গাড়ির নকল কাগজ তৈরির ব্যাপার তো আছেই। মেয়াদ ছাড়া গাড়ি, ফেরি, ট্রলার সবই অদৃশ্য কারণে লাইসেন্স পেয়ে যায়। এসব তো এক শ্রেণির মানুষের অনৈতিক ব্যবসা। এজন্য অসাধু দালাল চক্র রয়েছে। অতি পুরাতন গাড়িকে মালিক নিজে কখনও বিআরটিএ অফিসে টেস্ট করাতে নিয়ে যান না। ড্রাইভারের মাধ্যমে দালালের হাতে অতিরিক্ত কিছু ধরিয়ে দিলে ক’দিন বাদে নতুন কাগজ তৈরি হয়ে আসে। এসব রীতি-নীতির তেমন কোন পরিবর্তন এখনও হয়নি।

ড্রাইভিং লাইসেন্স না পেলে তাতে কী আসে যায়? রাস্তায় প্রতিনিয়ত লাইসেন্সবিহীন যান ও ড্রাইভার চলাচল করে যাচ্ছে। অধুনা নকল লাইসেন্স ধরার মত কোন প্রযুক্তি ট্রাফিকের হাতে নেই। নকল টাকা যে দেশে বাজারে সয়লাব হয়ে যেতে পারে সেদেশে নকল লাইসেন্স শনাক্ত করার মত আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল কোথায়?  তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তার গাড়ি বা ড্রাইভারদের ডকুমেন্ট ও মাদকাসক্তি টেস্ট করানোর মত পর্যায়ে আমরা কখনও কি যেতে পারবো? কারণ, আমরা তো সেই ধরনের কুশলী ও নৈতিক মানুষ তৈরি করতে পারছি না।

আমাদের দেশে এখনও মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ‘ফাও’ পেলে সিংহভাগ মানুষ খুশী হয়। সেটা টাকা বা ক্ষমতা যাই হোক না কেন- তাতে কোন আপত্তি নেই কারুরই। বাড়ির গৃহিনী বা সন্তান অভিভাবককে জিজ্ঞাসা করে না যে তোমার আয় কত, আর ব্যায় কর এত- সেটা কীভাবে যোগাড় কর? এসব বিষয়ে কারো কোন বিকার নেই। সবাই শুধু চাই, আর খাই-খাই মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছি। বড় হয়ে হচ্ছি অলস, অকর্মণ্য ও ফাঁকিবাজ।

ফলে ব্যবস্থাপনা হয়ে যাচ্ছে হেঁয়ালীপনায় নুব্জ্য ও ভঙ্গুর। কোন না কোন ক্ষেত্রে একটু যাচাই করলে দেখা যাবে, উড়োজাহাজ, পানিজাহাজ, প্রমোদতরী, স্পিডবোট, ট্রেন, বাস, ট্রাক সবকিছুতে মেয়াদছাড়া সেবা চালু রয়েছে।

মেয়াদছাড়া পরিবহনের সেবা চারু রাখার অর্থ হলো- সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।

এছাড়া নতুন যানবাহন কেনার ক্ষেত্রে কমিশন, ঘুষ, ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয় থাকায় সরবরাহকারীগণ নকল ও মানহীন পণ্য সরবরাহ করেন। হয়তো সেজন্য ডেমু ট্রেন এখন ডুবু ডুবু। ডেমুর ২৫ বছরের ওয়ারেন্টির মাত্র ৬-৭ বছরেই সাজঘরে দলে দলে ঢোকার কথা ছিল না। এগুলো সামান্য যন্ত্রাংশের অভাবে ভাগাড়ে পড়ে থাকার জন্য দায়ী কে হবে? চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারের বৃহৎ চৌকোনা খুঁটিতে এত দ্রুত ফাঁটল কিসের ইঙ্গিত বহন করে? আমাদের দেশে প্রকৌশলীরা ঠিক সময়মত ও নিয়মিত তদারকিতে না গিয়ে শুধু অজ্ঞ শ্রমিকদেরকে দিয়ে কাজ করান বলে অপবাদ প্রচলিত রয়েছে।

আমাদের দেশের বন্যা, বৃষ্টি, ভূমিধ্বস, গরমে বিদেশি সিস্টেমের প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেবার আগে মেগা প্রকল্প চালু করা শুরু হয়েছে। উন্নত রাস্তা তৈররি আগেই ভলভো, নতুন রেললাইন তৈরির আগেই ডেমু চালু হয়েছে। দ্বিতল রাস্তায় বড় গাড়িকে ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উঠতে দেয়ার নিয়ম, কিন্তু সেটা কোথাও চোখে পড়ে না। রাস্তা পাশ^বর্তী শহরের মানুষের বাসা-বাড়িতে বড় গাড়ির শব্দ যেন দূষণ ছড়াতে না পারে সেজন্য স্টিলের শব্দনিরোধক বেড়া দেয়ার প্রচলণ থাকলেও আমাদের দেশে সেটা চালু হয়নি। তাইতো গাড়ির গর্জনে ও রাস্তার কম্পনে দ্বিতল রাস্তার পাশের অফিস চালানো ও বাসায় বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সুতরাং, ঘোড়ার আগেই গাড়ি কেনা হয়েছে। মানুষের স্বাস্থ্য, এমিনিটি, স্বাচ্ছন্দ্য, এগুলো নিয়ে প্রচুর গবেষণা করার প্রয়োজন ছিল।

দেশজ বা ইনডিজিনাস প্রযুক্তির কথা মাথায় না নিয়ে বিদেশি চিন্তা-চেতনাকে হঠাৎ খাপছাড়াভাবে নিজেদের উন্নত আধুনিক জীবন সংগ্রামে বিকশিত করতে গিয়ে আমরা বড় ভ্যাকুয়ামের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি না তো?

নদীপথ এখনও আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রাণ। কারণ, নদীর রাস্তায় খরচ কম। নদীপথ ভেঙ্গে যাবার ঘটনা কম, ট্রাফিক জ্যাম কম। ভারী পন্য, বিদেশি দ্রব্যের আমদানী-রফতানির জন্য নদীপথই উত্তম মাধ্যম। কারণ দেশে হরতাল আন্দোলন হলেও নদীপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে না।

অথচ, অতি অবহেলায় আমরা শুধু একদিকে দৌড়াচ্ছি। অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে জনপরিবহনের সব পথকেই সমান গুরুত্ত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এটা হঠাৎ রাস্তা ঘেরাও, আন্দোলন, হরতালেরও দেশ। নদীভাঙ্গন ও ভূমিধ্বসের দেশ। মাত্র একবছরের বন্যা বা প্রবল বৃষ্টিস্নাত হলেই সকল রাস্তা-ঘাট ডুবে গিয়ে দ্রুত নষ্ট হবার দেশ। তাই শুধু ঢাকাকে কংক্রিট দিয়ে ভরালে চলবে না। জাপানের কোবে বা ইউক্রেন, আরিজোনার ভূমিকম্পের সময়ের কথা ও তার প্রভাবের কথাও মনে রাখতে হবে পরিকল্পনাবিদদের।

ঢাকার বাইরে নজর দিতে হবে বেশি করে। নদীভাঙা মানুষের দিকে নজর দিতে হবে আরো বেশি। গ্রামের মানুষের জন্য সস্তা পরিবহনের জন্য পুরাতন ফেরি, লঞ্চ ইত্যাদি ডাম্পিং করে নতুন নৌযান বানাতে বা কিনতে হবে।

পুরাতন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে আমরা পৃথিবীতে দ্বিতীয়। আমরা নতুন জাহাজ রফতানি করতেও শুরু করেছি। কিন্তু আমাদের জাহাজ-ফেরির তলা ফুঁটো হয়ে নদী তীরে ঘেঁষেও অথৈ পানিতে তলিয়ে যায় কেন? এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বরতরা কি আগেভাগে এসব মরণঘাতী তথ্য সম্পর্কে জানেন না? অতিপুরাতন ফেরি ও নৌযানগুলোর ব্যবহার এতদিনেও বাতিল করে দেননি কেন?

আমরা বিদেশি পুরনো জাহাজ কিনে স্ক্রাপ করি, নিজেরগুলো স্ক্রাপ করে নতুন কিনতে সরকারকে এতদিন প্রস্তাব দেয়া হলেও সরকার গুরুত্ব দেয়নি কেন? অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য সরকার এখন কাদেরকে দায়ী করবেন? এজন্য ফেরিকে, পথকে, পথিককে না পরিবহন বিভাগকে? দায়টা কাউকে তো নিতেই হবে। কারণ, রাজধানীতে কাঁচের ঘরে মুখোশ পড়ে শুধু পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলতে দেয়া যায় না।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর