সংলাপ: হোপ ফর দ্য বেস্ট!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-26 00:08:59

দেশে চলছে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি। আর প্রকৃতিতে শিশির-কুয়াশা নিয়ে হাজির হয়েছে হেমন্ত। ভোর রাতে উত্তুরে-পশ্চিমি ঠাণ্ডা বাতাসে ভর করে হাজির হচ্ছে একটু করে শিরশিরানিও। কোথাও দেখা মিলতে শুরু করেছে, 'একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু'। তাপমাত্রা একটু একটু করে নামছে।

আবহাওয়াবিজ্ঞান অনুযায়ী ঋতু মূলত তিনটি। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে পরিবর্তনের ফাঁকে হাজির হয় শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত। দুই ঋতুর মাঝে আসায় অনেক সময় এই ঋতুগুলির চরিত্র মালুম হয় না আমাদের কাছে। এই নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই ভাবপ্রবণ বাঙালি মধ্যবিত্তের।
এবার যেমন বর্ষার পর দুম করে শুকিয়ে যায় বাতাস। আকাশের মেঘের লেশমাত্র ছিল না। পরে আবার ঘূর্ণিঝড় তিতলির জেরে আকাশভরা কালো মেঘ। শরতের অস্তিত্বই টের পাচ্ছিলেন না জনতা। আবার তিতলি বিদায় নিতেই বাংলার আকাশে শরতের ছোঁয়া। পেঁজা মেঘের আনাগোনা।

শরৎ ফুরোনোর পর হেমন্ত আসতেও দেরি করেনি। ভোরের দিকে হাল্কা ঠাণ্ডার অনুভূতি। সঙ্গে কুয়াশা-শিশিরের উপস্থিতি। রাজধানীতে তেমন খোলাসা না-হলেও, উত্তরের বিভিন্ন প্রান্তিক জেলার বাসিন্দারা বুঝতে পারছেন, বাংলার ঋতু এ বার শীতের পথে এগোচ্ছে।

হেমন্তে শীতের আগমন বার্তার মধ্যেই নির্বাচনী রাজনীতি ঢাক-ঢোল বাজানো শুরু করেছে। বিভিন্ন নেতার দলবদল এবং বিভিন্ন দলের জোট গঠন পর্বের মধ্যেই শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন জোটের আলোচনা বা সংলাপ।

দেশ এখন পুরোই সংলাপময়। সংলাপে কে যোচ্ছেন, কে কি খাচ্ছেন বা খাচ্ছেন না, কি বলছেন, কে বেশি বলছেন, কে বলছেন না-এসব নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-জল্পনা-কল্পনা। শুরুতেই সংলাপ সফল না ব্যর্থ সে আলোচনাও ঘুরেফিরে আসছে।

ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে, সংলাপের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনোদিন বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন যা এসেছে- তা লড়াই-সংগ্রাম-রক্তপাতের ভেতর দিয়ে। সংলাপ সে ক্ষেত্রে পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার একটা মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। আমরা যদি বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে সংলাপের ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলাই তাহলে দেখি ১৯৭১-ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো সংলাপ, ফলাফল-মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৮৮-৯০-স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটদ্বয়ের বেশ কিছু সংলাপ, ফলাফল- আন্দোলনে এরশাদের পতন। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল এবং বিএনপি মহাসচিব মরহুম মান্নান ভুঁইয়ার সংলাপ, ফলাফল-সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত অসাংবিধানিক সরকার!

কিন্তু মানুষতো আর ইতিহাসের দাস নয়; ইতিহাস নির্মাতা। ইতিহাস রচিত হয় না; একে রচনা করতে হয়। একইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হয়- ইতিহাসের গতিপথ কখনোই সরলরৈখিক নয়। হয়নি বলে কখনও হবে না-এটাও ঠিক নয়।

আরেকটি কথা। আমরা যদি একে-অপরকে বুঝতে চাই, বুঝতে পারি তাহলে সত্যিই কি আলোপ-আলোচনা, কথা বা সংলাপের কোনো প্রয়োজন আছে? একজন বোবা কোন ভাষায় তার অনুভূতি ব্যক্ত করে, কথা বলে বা সংলাপ করে? একথা ঠিক যে মানুষ তার আবেগ-অনুভূতি নানা ভাষায় ব্যক্ত করে। কিন্তু না বুঝতে চাইলে সেই ভাষা বা কথার কোনো মূল্য নেই। আবার কোনো বিশেষ ভাষা বা কথা না হয়েও কিছু ভাষা আছে যা চিরায়ত ভাষা। এই ভাষার কোনো নাম নেই। একটা হাসির ভাষা কী? সমুদ্রের ঢেউয়ের ভাষা কী? চোখের জলের ভাষা কী? একটা শিক্ষিত বেকারের চাকরি খোঁজার লড়াইয়ের ভাষা কী? প্রেমের বা ঝগড়ার ভাষা কী? সন্তান জন্মের পর মায়ের আনন্দ অশ্রুর ভাষা কী? মৃত্যুর পর স্বজনের হৃদয়ে যে অনুভূতি তার ভাষা কি? পাহাড় শৃঙ্গ থেকে নদী যখন লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত্তিকায় আছাড় খায় তখন তার ভাষা কী? এগুলো কি ভাষা নয়? এসব ভাষায় কি সংলাপ হয় না?

তারপরও আমাদের দেশের রাজনীতিতে বার বার সংলাপের প্রয়োজন হয়। সংলাপের দাবি ওঠে। ঘটা করে সংলাপ হয়। যেমন এখন হচ্ছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন দল ও জোটের সংলাপ শুরু হয়েছে। প্রথমেই সংলাপ হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার মিত্রদের নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে।

প্রধানন্ত্রীর বাসভবনে সংলাপ শেষ করে বেরিয়ে ঐক্যফ্রন্টের মূল উদ্যোক্তা ড. কামাল হোসেন আলোচনাকে “ভালো’’ বলে আলোচনা “ফলপ্রসূ হবে”বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আবার ‘বিশেষ কোনো সমাধান’পাননি বলেও মন্তব্য করেছেন!

পক্ষান্তরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করেই বলেছেন, “আমরা (আলোচনায়) সন্তুষ্ট নই।” বিএনপির অবশ্য ‘‘সন্তুষ্ট’’হওয়ার তেমন কোনো কারণও নেই। কারণ বিএনপির দাবি-দাওয়া অনেক বেশি। সেগুলো মানলে আইন-আদালত-বিচার ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করতে হয়। যা অসম্ভব।

উল্লেখ্য, নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে নিয়ে জোট গঠন করে যে সাত দফা তুলে ধরেন কামাল, তার মূল দাবি হল খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ভোটের সময় বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন ও সভা-সমাবেশে বাধা অপসারণের দাবিও তোলে ঐক্যফ্রন্ট।

সভা-সমাবেশে বাধা অপসারণের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক মামলা থাকলে তার তালিকাও চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তালিকা আপনারা দেন। আমি অবশ্যই বিবেচনা করব যাতে হয়রানি না হয়। উত্থাপিত দাবি-দাওয়া নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনার দ্বার খোলা রাখার প্রতিশ্রুতিও প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন।

একথা ঠিক এই সংলাপের মধ্য দিয়ে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। ড. কামাল যথার্থই বলেছেন, “আমরা সংলাপের সুযোগ পেয়েছি। আমরা আমাদের কথা বলে এসেছি উনাকে। উনি জানতে পেরেছেন। উনি উনার কথাগুলো বলেছেন। উনার মনের কথাও আমরা কিছুটা জানতে পেরেছি।”

এই সংলাপে কী অর্জন হয়েছে? হয়তো কিছুই হয়নি। “এক দিনে সব অর্জন হয় না”- এটা ঠিক। ছোট গ্রুপে আলাপ-আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, সেটাই এই সংলাপের সবচেয়ে আশাবাদের দিক।

দেশটা যেহেতেু আমাদের সকলের, সবাই মিলে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। এ জন্য বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নিশ্চয়ই যে যার অবস্থান থেকে কথা বলবেন, কিছু ছাড় দেবেন। সংলাপের মাধ্যমে যে সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসা করে আগামী দিনে জাতিকে সুষ্ঠু ও সকল দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে-দেশবাসী এটাই প্রত্যাশাই করে।

আমরাও সংলাপের ব্যাপারে আশাবাদী হতে চাই। হোপ ফর দ্য বেস্ট!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর