ইউপি নির্বাচনে একপক্ষই যখন দুই প্রতিপক্ষ

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 05:56:08

আমরা-আমরা ইউপি নির্বাচনে এত সহিংসতা ও এত নৃশংস মৃত্যু কিসের ইঙ্গিত বহন করছে? ক্ষমতা কি জীবনের চেয়ে এত দামী? জীবনকে দামী ভেবে দীর্ঘ করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল কেন তাহলে? জীবন যদি এত ফেলনা জিনিস হয় তাহলে কেন এত প্রচারণা, কেন এত করোনার টিকা কেনা? কেন এত মৃত্যুভয় করে মানুষ ঘরকোণায় চুপ করে বসে ছিল?

দেশে ইউপি নির্বাচনে দলীয় ব্যানারে নির্বাচন করা হচ্ছে। নভেম্বর শুরু হতেই গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপক তোড়জোরের মধ্যে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিরোধী দল ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত রয়েছে। তবে তাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচন করছে বলে বলা হচ্ছে।

আগেকার দিনে ইউপি নির্বাচন হতো দলবিহীন। এলাকার গণ্যমান্য ও সবার পরিচিত শ্রদ্ধাভাজন ব্যাক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতো। বিশেষ পারিবারিক পরিচিতিও প্রাধান্য পেত কোন কোন এলাকায়। তাদের ভিতরে মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়পরায়ণতা কাজ করতো। ফলে পুলিশের দরকার হতো না।

কাজী, চৌধুরী, খান, তালুকদার, মোল্যা, মাতবর ইত্যাদির পরিচিতি আজকালকার নির্বাচনে কোন প্রভাব বিস্তার করে না। এলাকাপ্রীতিও এখন তেমন কোন ফ্যাক্টর নয়। এখন জায়গা এসবের দখল করেছে উঠতি টাকাওয়ালা লোকেরা এবং কার পিছনে কত পেশীওয়ালা রয়েছে তারা। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে কার কত শক্তিধর আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত সাহায্যকারী ইত্যাদি ছিল বা আছে তারা বেশী সুবিধা পেয়ে যান ইউপি নির্বাচনে। কোন কোন প্রার্থী এগুলো বড়াই করে বলে বেড়ান ও লোকজনকে ভয়-ভীতি দেখান। এধরনের শক্তির সাথে যুক্ত হয় এলাকার পেশীশক্তিকে অর্থবলে কাজে লাগানো। এই দুই শক্তি মিলে কোন প্রার্থীর সমন্বয় ঘটলে নির্বাচনি মাঠ দখলে চলে যায় তার দখলে। ফলে অসহিষ্ণুতা ও নির্বাচনি আইন অমান্য করার প্রবণতা তৈরী হয়। তখন পুলিশি পাহারা বসিয়ে কোন কাজ হয় না।

কোন এলাকায় উভয়পক্ষ বা প্রতিপক্ষ যদি সবল হয় শুধু সেখানে নিবাচনি তাহলে মাঠের লড়াই জমে উঠে। অন্যথা ঘটলে পরিস্থিতি চলে যায় ‘একাই খাব একাই নেব’ নীতিধারীদের দখলে।

প্রতিপক্ষ একটু দুর্বল হলেই তার কপালে নির্বাচন করার বদলে জোটে নির্যাতন। পারস্পরিক সহনশীলতা রক্ষা করার কোন কৌশল কার্যকরী করতে পারে না নিয়োজিত নিয়ন্ত্রক সদস্যরা। শক্তিশালী প্রার্থীরা তাদেরকে বিভিন্ন কৌশলে বশ করে ফেলে। ভাল খাবার, ঘুমানোর জায়গা, অর্থ দিয়েও তাদেরকে হাত করে ফেলার কথা শোনা যায়। এ সব দিয়ে কাজ না হলে কোন্দলের শিকার হন তারাও। এভাবে নির্বাচনি খেলার পরিবর্তে ভয়ংকর যুদ্ধের অবতারণা শুরু হয়।

এবারের ইউপি নির্বাচনে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ জন মানুষ নির্বাচনি সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের। গাংনীতে দুই ভাই প্রাণ হারিয়েছেন, অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। (দৈনিক ইত্তেফাক ০৯.১১.২০২১)। নভেম্বর ১০ তারিখে খুন হয়েছেন আরো তিনজন। নভেম্বর ১১ তারিখে খুন হয়েছেন আরো সাতজন। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন বড় বেকায়দায় পড়ে গেছেন।

এতগুলো মৃত্যু ঘটাতে প্রতিপক্ষের উপর হাতবোমা, ছুরি, চাকু, ককটেল, রামদা, বল্লম, টেটা, হকিস্টিক, লাঠি, বন্দুক সবকিছুই ব্যবহৃত হয়েছে। এ পর্যন্ত নরসিংদীর রায়পুরা, চাঁদপুরের বালিয়া, হবিগঞ্জের জলসুখা, মাদারীপুরের কালকিনী, নাটোরের বড়াইগ্রাম, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী কোথায় হয়নি সহিংস সংঘর্ষ?

কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, জালভোট প্রদান, অফিস ও বাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, মারপিট, নির্যাতন সবকিছুইতো সব গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে। সারা পৃথিবীব্যাপী নির্বাচনি সহিংসতায় মৃত্যু ঘটনার ভিডিও বার বার প্রচারিত হচ্ছে। এই কয়দিনে ৪০ জন মানুষ যুদ্ধসদৃশ সংঘর্ষে মারা গেলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এটু ঝগড়াঝাটি হয়ে থকে।’ আর নির্বাচন কমিশন সচিব বলছেন, ‘কেন্দ্রে কোনও মৃত্যু ঘটেনি!’ ঘরের বাইরে অথবা বাড়ির আঙিনায় যদি বাড়ির কোন সদস্যের মৃত্যু ঘটে তাহলে কি তাকে ওই বাড়ির সদস্য বলা হবে না? ৪০ জন মানুষের মৃত্যু ও হাজার মানুষ আহত হওয়া- এগুলো যদি একটু ঝগড়াঝাটি হয় তাহলে অনেক ভয়ংকর কোনটি? দায় এড়ানোর পুরনো কৌশল এখন ভোঁতা। গ্রামে এখন আধিপত্যবাদ বলতে কিছু নেই। আছে উঠতি ধনী ও রাজনৈতিক লাই পাওয়া পেশীশক্তির নির্যাতন, ছিনতাই-ডাকাতি।

নির্বাচনে ক্রমাগত নৃশংশতার উত্তরণ কেন হচ্ছে তা সবাই জানেন। মূল কারণ হলো- আমরা আমরা নির্বাচন করতে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনের মত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বা ‘ফাও’ শিকে ছিঁড়ে ক্ষমতা যদি জোটে তাহলে মন্দ কী? তাই আমরা পোকারা (উইপোকা বা আমরা পোকা উন্নয়ন খেয়ে ফেলছে বলে সংবাদ হয়েছে) সবাই ক্ষমতার স্বাদ পেতে আগ্রহী। সেজন্য মনোনয়ন পেতে সবাই মরিয়া। এজন্য বিদ্রোহী প্রার্থী ছড়াছড়ি শুরু হয়েছে। এজন্য যত ব্যায় করতে হয় করতে চাই এমন মানসিকতা তৈরী হয়েছে নব্য টাকাওয়ালাদের মধ্যে। ফলে এক অন্যের উপর অন্যাভাবে রেলিয়ে দিতে কার্পণ্য করছে না অনেক এলাকার মানুষ। এসব দেখে ভাল মানুষেরা প্রার্থী হবার পরিবর্তে ভয়ে গর্তের মধ্যে মুখ লুকিয়ে আছেন।

কোন এলাকার মানুষ যদি বেপরোয়া মনোভাব পোষণ করেন তাহলে সেখানে বাইরের গুটিকয়েক পুলিশ ও অচেনা একজন ম্যাজিস্ট্রেট হঠাৎ একদিন এসে নির্বাচনি ‘মব’-কে কিভাবে সহজে নিয়ন্ত্রণ করবেন? এ অবস্থা অনুধাবণ করে হয়তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে পাহারা দিয়ে নির্বাচনি সহিংসতা ঠেকানো যায় না’। তিনি আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে ৮৯তম কমিশন বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের আরো বলেন, ‘..আমরা পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছি। যার যার দায়িত্ব সে সে পালন করে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে, মহল্লায় মহল্লায় পুলিশি পাহারা দিয়ে নির্বাচনি সহিংসতা ঠেকানো যায় না। এটি ঠেকানোর একমাত্র উপায়, যারা নির্বাচনে অংশ নেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যারা আছেন, তাদের সহনশীলতা এবং আচরণবিধি মেনে চলা।’ (দৈনিক ইত্তেফাক ১০.১১.২০২১)।

কিন্তু এখন মানুষের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ঘটাবে কে? মানুষের ইতিবাচক মনোভাবের জন্য যে পারিপার্শিক উন্নত নৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন তা কি দেখে শিখবে? গ্রামের ভোটারদের মনে ভয় যদি সকালে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখে যে রাতের আঁধারে তাদের ভোট আগেই কেউ দিয়ে গেছে তাহলে কি হবে? তবে কোন আশায় তারা সহনশীল হবে বা আচরণবিধি মেনে চলবে? তাই এমন নাজুক পরিস্থিতিতে এমন হতাশার কথা জনগণকে না শোনানোই ভাল।

আইন দিয়ে মানুষের দৈহিক গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও মনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ দুঃসাধ্য। পুলিশ পাহারা দিয়ে পুলিশি রাষ্ট্র হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট বা নির্ভেজাল ভোট করতে হলে নির্ভেজাল ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হয়। জনমত আর জালিয়াতী মত এক জিনিস নয়। প্রথমটা অর্জনের জন্য সহনশীলতা প্রদর্শণ ও সুষ্ঠু সামাজিক ন্যায়বিচার জনগণের মনের ভিতর থেকে আপনা আপনি ম্যাজিকের মত বের হয়ে আসবে কি? সেটা আসার পরিবেশ সৃষ্টি করবে কে? ইতিবাচক মনো:-সামাজিক পরিবেশ পচে গলে নষ্ট হতে থাকলে সেটাতে পুনরুজ্জীবন দান কারার মানুষগুলো কোথায় যেন অভিমান করে চুপসে গছে। তাইতো ইউপি নির্বাচনে এত সহিংসতা ও এত নৃশংস মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে গিয়ে যদি স্থানীয় জনগনকে আত্মাহুতি দিতে হয় তাহলে সে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দরকার কি?

সামান্য ক্ষমতা পাবার লোভে ইউপি নির্বাচনে একপক্ষই যখন দুইপক্ষ হয়ে মারণাস্ত্র নিয়ে আপন ভাই-প্রতিবেশীর উপর আক্রমণ চালায় তখন তাদেরকে আরো রাজনৈতিক লাই দেবার অর্থ কি দাঁড়ায়? এত ভয়ংকর মৃত্যু আগামী প্রজন্মের জন্য কোন্ ধরনের ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে সেটাই এখন মূখ্য প্রশ্ন।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর