অবশেষে সত্যিই পরিবেশের বাঘ আসছে!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 06:23:19

 

গল্পে মিথ্যাবাদী রাখালের বাঘ যেমন সত্যি সত্যিই একদিন এসে হানা দেয়, তেমনই পরিবেশের বাঘও আসছে! পরিবেশ বিপর্যয়  নিয়ে 'হবে' 'হবে' বলা হচ্ছিল, সেসব হতে শুরু করেছে। পরিবেশ সমস্যা এখন বিশ্বের সামনে ভবিষ্যতের নয়, বর্তমানের চলমান বিপদ।

কার্বন নিঃসরণ, বায়ুস্তরে ফাটল, উষ্ণায়ন, এসিড বৃষ্টি, হিমালয়ে হিমবাহের গলন, আমাজান বনাঞ্চল ও অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকার অরণ্যে দাবানল, উত্তাল সমুদ্র বার বার জলবায়ুর বিপদজনক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। বিশ্বনেতৃত্ব সেসব নিয়ে এন্তার আলাপ-আলোচনা করেছেন ফলহীন উপসংহারে দাঁড়িয়ে। এখন সেসব বিপদ অক্টোপাসের মতো হামলা করছে। বিপদ বাড়ছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেও।

বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি নিয়েও দুশ্চিন্তার কথা বার বার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য এলাকার তুলনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতাবৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বাধিক। যার অর্থ, আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় সমুদ্র ক্রমেই আরও বেশি করে মানুষের দরজার একেবারে গোড়ায় এসে দাঁড়াবে।

সমুদ্র ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালে কী হয়, আমরা গত কয়েক বছরে বারংবার তার প্রমাণ পেয়েছি। পরিবেশ বিষয়ক নানা গবেষণা রিপোর্টে একেবারে উদাহরণ দিয়ে সেসব দেখানো হয়েছে। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর ও আরবসাগরে বর্ষার আগে-পরে সাইক্লোনের সংখ্যা ও তীব্রতা কী ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, তা কারো অজানা নয়।

পরিবেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২১ - মাত্র এই দু'বছরের সময়সীমায় দশটির বেশি অতি-উচ্চ ও মাঝারি-উচ্চ ক্ষমতার সাইক্লোন, যেমন সাইক্লোন গুলাব (অন্ধ্র ও ওডিশা), টুকটে (কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও গুজরাট), ইয়াস (পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা), নিসর্গ (মহারাষ্ট্র), উম্পুন (ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গ), কিয়ার (গোয়া ও মহারাষ্ট্র উপকূল ছুঁয়ে ওমান এবং গালফ অফ এডেন), মহা (গুজরাট), বায়ু (গুজরাট, পাকিস্তান, মলদ্বীপ), হিকা (ওমান), ফণী (অন্ধ্র, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ), বুলবুল (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ), একের পর এক তছনছ করেছে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের একাধিক দেশগুলোকে।

এখানেই শেষ নয়। আন্তর্জাতিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থা আইপিসিসি-র হুঁশিয়ারি, এ ধরনের ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

শুধুমাত্র হুঁশিয়ারি দিয়েই থামেনি আইপিসিসি-র রিপোর্ট। রীতিমতো অঙ্ক কষে দেখিয়েছে, যদি এখনই কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করা না-যায়, ২০৪০ সালের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রাক্‌-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। যথেচ্ছ শিল্পায়ন ও অনিয়ন্ত্রিত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বজায় থাকলে, অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে 'নেট-জিরো' বিন্দুতে পৌঁছতে না-পারলে এই শতকের মাঝামাঝি তা ২ ডিগ্রিও ছুঁয়ে ফেলতে পারে।

তখন পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হবে, তা ভেবে আতঙ্কিত হতে হয়। এমনই আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে বিশ্বের দেশগুলো আর কোটি কোটি মানুষ। উন্নত দেশগুলো সাধ্যমতো পদক্ষেপ নিলেও নিজেদের বাঁচাতে পারবে না। কারণ বৈশ্বিক বিপদ থেকে একক কোনও দেশের পক্ষে বেঁচে থাকা দুষ্কর। যেমন, চলমান করোনা মহামারির বৈশ্বিক দাপটের সামনে বিশ্বের ধনী-গরিব সকল দেশই অসহায়।

দরিদ্র দেশগুলোর বিপদ বেশি। তাদের প্রস্তুতি কম। মোকাবেলার সামর্থ্য আরও কম। পাশাপাশি পরিবেশ ব্যবস্থাপনা দুর্বল। আইন শিথিল। পরিবেশের প্রতি মানুষের শৈথিল্য প্রবল।

জ্বালনির অপব্যবহার, বৃক্ষ নিধন, নদী দখল ইত্যাদি দরিদ্র দেশে সীমাহীন। পরিবেশের বিরুদ্ধে কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ চলে অবাধে ও প্রকাশ্যে। যার কুফল ভোগ করছে দক্ষিণ এশিয়াও। দিল্লি, লাহোর, মুম্বাই, কলকাতা বায়ু দূষণে নাকাল। জীবন সেখানে দুর্বিষহ।

বাংলাদেশে যে হারে পরিবেশ হানি চলছে, তাতে বিপদ যেকোনও সময় আঘাত করতে পারে। বৃক্ষ নিধন, নদী দখল, পাহাড় কর্তনের ধারায় প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত। রাজধানীসহ বড় শহরের আবাসিক এলাকায় ভয়ঙ্কর রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা। শহরের মাঝখানে শিল্পাঞ্চল। বর্জ্য ও বায়ু দূষণ বিরামহীন।

এমন পরিবেশ হানিকর পরিস্থিতি পরিবর্তন বা বদলের জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী পরিবেশ নীতি ও পদক্ষেপ। নগর বিন্যাস পুনর্গঠন। শিল্প আরও দূরে আলাদা জায়গায় সরিয়ে দেওয়া। পরিবেশ ও প্রকৃতি বিরোধী কার্যক্রম কঠোর হস্তে দমন করা। তা যদি না করা হয়, তবে অবশেষে সত্যি সত্যিই পরিবেশের বাঘ এসে আমাদেরকেও হনন করবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর