শিক্ষক নেই তো পড়াবে কে?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 02:30:05

দেশে এত ডিগ্রীধারী বেকার মানুষ, এত চাকরি প্রত্যাশী তবু শিক্ষক নেই। শিক্ষক সংকট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছে বলে বার বার সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। বিষয়টি বেশ শ্রুতিকটু।

স্কুলে সহকারী শিক্ষকের নিয়োগ প্রদানের জন্য সেই কবে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সহকারী শিক্ষকের আড়াই হাজার শুন্যপদে নিয়োগদান প্রক্রিয়ার ধীরগতির ফলে চাকরি প্রত্যাশীরা ভীষণ হতাশ। তারা অনেকেই মেধাবী হওয়ায় ইতোমধ্যে ভিন্ন ও অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় পেশায় চলে গেছে।

এ পর্যায়ে বেশি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানির বিষয়টি। মাধ্যমিকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ২,১৫৫ জনের চাকরি ঝুলে আছে। ভেরিফিকেশনে ধীরগতি ও রাজনৈতিক বিবেচনার নামে ছুঁতো খুঁজে বের করে হয়রানির মাত্রা চরম পর্যায়ে চলে গেছে বলে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগ সব ধরনের চাকরি ও পদন্নোতির ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।

এটা ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতাকে আরও বেশি উস্কে দিয়েছে আমাদের সমাজে। কারণ, যারা এই সেবায় নিয়োজিত তারা নিজেরা অনেক বেশি অর্থ খরচ করে চাকরি পেয়েছেন বলে নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা অবৈধ কায়দায় সেই অর্থ অর্জন করতে তৎপরতা চালাতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে সামাজিকভাবে দুর্বল শ্রেণির পরিবারের প্রার্থীদের উপর নিয়মের খড়গের বোঝা নেমে আসে।

অথচ, একই চাকরি বা প্রমোশনের ভেরিফিকেশনের বেলায় কোনো প্রার্থীর পৃষ্ঠপোষকতায় হোমড়া-চোমরা কেউ আছে সেটা আঁচ করতে পারলে তারা নীরবে বিনা হয়রানিতে খুব দ্রুত তাদের কাজ করে দেন বলে জানা গেছে। তাই ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় মাৎস্যন্যায়ে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছে।

তাই আধুনিক যুগে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও পক্ষপাতিত্বের কারণে এ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া দরকার বলে অনেকে মনে করেন। কারণ এই হয়রানি দিন দিন ঘুষ-দুনীতি, সামাজিক অস্থিরতা ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি ও তা বৃদ্ধি করে চলেছে। সরকার একটি সামাজিক শুমারির মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের পারিবারিক ডাটাবেজ তৈরি করে তা সরকারি ডাটাব্যাংকে রেখে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়।

তাহলে প্রতিবেশী দেশের চটপটে ইংরেজি জানা বাংলাভাষী বিদেশিরা আমাদের দেশে তাদের আত্মীয়দের মাধ্যমে এদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে আরেকটি উচ্চতর বাংলাদেশি ডিগ্রী করা বা সরকারি চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পাবে না।

তাই শুধু আমাদের দেশে অবস্থানরত বিদেশিরা কিভাবে চাকরি করছে, তাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে কি-না বা তারা ভুয়া কি-না সেগুলোর অনুসন্ধান করা দরকার। আমাদের দেশে দশ লক্ষের অধিক বিদেশি বিনা ট্যাক্সে চাকরি করে অর্থ পাচার করছে বলে সংবাদে জানা গেছে। তাদের এদেশে চাকরি করা ও অবস্থানের বৈধতার উপর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা দরকার।

দেশের বহু উচ্চশিক্ষিত মেধাবীরা শত শত আবেদন করে চাকরি লাভ করতে না পেরে অবশেষে প্রাইমারি স্কুলে যোগদান করে। কারণ, বড়পদের সরকারি চাকরিতে প্রতিযোগিতা খুব বেশি। তার ওপর ভাইভা পর্যন্ত গিয়ে নানা ছলা-কলার সম্মুখীন হয়ে অনেকই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একটি ওপেন সিক্রেট যোগ্যতার কাছে নতজানু হয়ে বিফল হয়ে পড়ে। সব প্রার্থীর শক্তিশালী রাজনৈতিক ক্ষমতাধর আত্মীয়, বন্ধু বা সুপারিশকারী নেই। বেসরকারি চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রকট।

কারণ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি সাধারণত: নিজেদের আত্মীয় ও পরিচিতজনদের মধ্যে ভাগাভাগি করে পাবার অলিখিত নিয়ম আমাদের দেশ বেশি প্রচলিত। কোনো প্রাইভেট ব্যাংক বা কোম্পানিতে বিশেষ যোগ্যতা ব্যাতিরেকে মালিক বা পরিচালকমণ্ডলীর পরিজন ছাড়া চাকরি পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। সেগুলোতে খালি হয় পদ। শুন্য পড়ে থাকে নিজেদের আপনজনের যোগ্যতা না হওয়া পর্যন্ত।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পার্টমার দিয়ে কাজ চালানোর প্রবণতা আরও বেশি। আমাদের দেশে শত শত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী শিক্ষক-কর্মচারী নেই। এমনকি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিসি-প্রোভিসি ও ট্রেজারারও নেই।

অদৃশ্য কারণে দায়সারা ভাবে শিক্ষাকার্যক্রম চালানো হচ্ছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সেগুলাতে রাতদিন ক্লাস নেন, পরীক্ষা নেন। তারা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও পড়ানোর যথেষ্ট সময় বের করতে পারেন না।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষক নিয়োগে কার্পণ্য করা হয় নানা কারণে। এভাবেই চলে আসছে আমাদের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম। এভাবে নতুন নিয়োগ ও পদায়ন ছাড়াই চলছে তাদের কাজ।

অপরদিকে বেকারদের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সেগুলোতে স্থায়ী নিয়োগের সুযোগ বা চাকরি পাচ্ছেন না। কেউ কেউ অর্থাভাবে বা সময় কাটানোর জন্য সেগুলোতে ঢুকে যাচ্ছেন। বেতন বেশি পেলে প্রাইভেট ব্যাংকের চাকুরেরা ব্যাংক বদল করতে দেরি করেন না। অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও একই কাজ করে থাকেন। ভাল অফার পেলেই হলো।

গণিত, ইংরেজি, আইসিটি বা কম্পিউটারের শিক্ষকগণ বেশি আয়ের সুযোগ পেলে এক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে ঘন ঘন চাকরি বদল করে থাকেন। বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই সাময়িক চাকরি লাভ করেন তারা। তাই বেশি অর্থ হাতছানি পেলে কর্মরত প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে এক মিনিটও দেরি করেন না তারা। এ যেন প্রাইভেট টিউশনি করার মত অবস্থা।

যারা চেষ্টা করেও ভিন্ন পেশার চাকরি জোটাতে পারেননি তারা নিরুপায় হয়ে সরকারি স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাবার জন্য দিনক্ষণ গুনে বসে কালাতিপাত করছেন। অন্যদিকে সরকার বলছেন শিক্ষক অভাবে শিক্ষালয়ে পাঠদানে নিদারুণ সংকটের কথা।

অপরদিকে পদ নেই তাই স্কুলগুলোতে প্রদান শিক্ষক পদে পদায়নের সংকট প্রকট। অপরদিকে বলা হচ্ছে, পদন্নোতিযোগ্য শিক্ষক নেই ২৬২টি স্কুলে। এই উভয়বিধ সংকটে নিপতিত হয়ে পদমর্যাদা ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন হাজার হাজার শিক্ষক।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা প্রশাসকগণ অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু তাদের সেসব বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। বরং অধিকাংশ জায়গায় তারা সংযুক্ত হয়ে পড়েছেন ভৌত নির্মাণ কাজে। তাদের আসল উদ্দেশ্য যেন নস্যাৎ হয়ে না যায়।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪,১৫০টি শিক্ষকের পদ শুন্য (দৈনিক ইত্তেফাক ১৫.১১.২০২১) এক শ্রেণির ভিসিগণ অবৈধ পন্থায় নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদেরকে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে শিক্ষার কোয়ালিটিকে মিশিয়ে দিয়েছেন। তাদের স্বেচ্ছাচারীতার তদন্ত শেষে অনেকের নামে এখন মামলা ঝুলে আছে। সেগুলোরও কোনো অগ্রগতির খবর শোনা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে ৫৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯৭,৭৯৫ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ছাত্র ১৯৩,৩৫৮ জন এবং ছাত্রী ১৪০,৪৩৭ জন। শিক্ষকের সংখ্যা ১৫,২৯৩ জন। তার মধ্যে চার হাজারেরও বেশি পদ শুন্য থাকলে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করে এত কোর্স পড়ানোর মানুষ কোথায়?

সেদিন একটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় সেরা হয়ে ডিনস্ পুরষ্কারপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপক জানালেন- তার মতে উচ্চশিক্ষায় হেকেপ, আইকিউএসি-র ফলাফল শুণ্যের কোঠায়।

সেসব প্রকল্প কিছু ল্যাপটপ, চেয়ার-টেবিল ক্রয় ছাড়া আমাদের গবেষণায় কাজের গুণগত মাননোন্নয়নে আর কিছুই দিতে পারেনি। নামকরা গবেষকগণ সেসব প্রকল্পে দু’তিনবার আবেদন করেও অনুদান পাননি। বেশিরভাগ প্রকল্প বরাদ্দ করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।

সেসব প্রকল্পের গবেষণা ফলাফল থেকে কতটি মানসম্মত আর্টিকেল বা বই প্রকাশিত হয়েছে তার খোঁজ কি কেউ নিয়েছে? আমাদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার যদি এই অবস্থা চলতে তাকে তাহলে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢাললেও বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বাড়ানো যাবে না।

তাই এসব দুরাবস্থা নিরসণে প্রকৃত গবেষকদের মূল্যায়ণ করতে হবে। ফেয়ার ফ্যাকাল্টি নিয়োগ পদ্ধতি মেনে মেধাবী শিক্ষক ও গবেষক নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতে এক সময় অন্তঃসারশুণ্যতা তৈরি হবে।

যার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে অনুধাবণ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নিজেই। কারণ, শিক্ষকতার মত মহান পেশায় মেধাবীরা আসতে চায় না। আসলেও থাকতে চায় না। ফলে আমরা হারাচ্ছি মেধা। শুন্য হচ্ছে পদ। এভাবে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় ক্রমাগত আসা-যাওয়ার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষকের পদ খালি পড়ে থাকলে উপায় কি? ভাল শিক্ষক নেই তো ভালভাবে পড়াবে কে?

লেখক: অধ্যাপক সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর