বুয়েট শিক্ষকদেরও শাস্তি হওয়া উচিত নয়?

, যুক্তিতর্ক

মনোয়ার রুবেল | 2023-09-01 12:35:16

একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ; আবরার হত্যাকাণ্ডের রায়ে খুশি বুয়েটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সংবাদ শুনে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ও হতাশার বিষয় আর কি হতে পারে? আবরার হত্যাকাণ্ডে বিশজন ছাত্রের ফাঁসির রায় হয়েছে, পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। এই খবরে বুয়েট শিক্ষকরা খুশি! কি ভয়ঙ্কর সংবাদ!

সাধারণ ছাত্ররা খুশি হতে পারে এতে, কারণ তাদের বন্ধু নিহত হয়েছে। তারা সমবয়সী। তারা অন্য ছাত্রদের অভিযুক্ত ভাবতে পারে। কিন্তু শিক্ষকরা কেন? নিহত আবরার যেমন এই শিক্ষকদের ছাত্র, এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে ফাঁসিতে দণ্ডিত যারা, তারাও তাদের ছাত্র। তাহলে তাদের ফাঁসির রায়ে শিক্ষক উল্লসিত হচ্ছে কেন? খুবই অবাক হয়েছি!

সবাই এই ছাত্রদের উচ্ছন্নে যাওয়া তরুণ বলছেন। যেদিন তারা বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল সেদিন তারা আমার আপনার সন্তানের মতো কিশোর ছিল, হাসিখুশী দুষ্টু ছিল, নিষ্পাপ ছিল। তারা কৌতুক করত, গান করত, কেউ কবিতা লিখত, লুকিয়ে বান্ধবীকে প্রেম মাখা মেসেজ দিতো, কেউ লজ্জা পেত, মায়ের জন্য কাঁদতো, বাবাকে মিস করতো, নিশ্চয়ই তারা খুনসুটিতে ভেসে যেত, টাকার জন্য মায়ের সাথে অভিমান করত। বড়কথা, এই কিশোররা দুর্দান্ত মেধাবী ছিল৷ হাজার হাজার ছেলে মেয়ের সাথে তারা পরীক্ষায় বসেছিল৷ সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল,  যেদিন তারা বুয়েটে পা রেখেছিল৷ এরপর একদিন বাবা মায়েরা পরম আস্থায় তাদের সন্তানদের বুয়েটের হোস্টেলে রেখে গিয়েছিলেন৷ সেদিন নিশ্চয়ই তারা বখাটে ছিল না। সেদিন তারা পিতার উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তান ছিল না।

ফাঁসির রায়ে কোন দণ্ডিতের বাবা এসে এই হোস্টেল বা এই শিক্ষকদের যদি জিজ্ঞেস করেন, স্যার, আমার নিষ্পাপ কিশোর সন্তান আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সে হিংস্র হল কিভাবে? কেন সে তার আরেক সতীর্থকে খুন করেছে? বুয়েটের একজন শিক্ষকও এর উত্তর দিতে পারবেন? বুয়েটের শিক্ষকরা তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেননি। ছাত্রদের নীতিবোধ শেখাতে পারেননি। নীতিবান শিক্ষক তার এককজন ছাত্র খুন হওয়া, এবং এর দায়ে আরেকজন ছাত্রের ফাঁসি হওয়াতে ভেঙে পড়তেন, লজ্জিত হতেন। তা নয়, তারা “খুশি হয়েছেন” জানিয়েছেন! এখন কেউ দাড়িয়ে বলতে পারেন সেই ছাত্রগুলোরই নয়, সাথে সাথে বুয়েট শিক্ষকদেরও ফাঁসি দেয়া উচিত। যে কারখানা মানুষ তৈরির বদলে হিংস্র করে তুলেছে, তার কাঠামো ভেঙে দেয়া উচিত। এই শিক্ষকদের কি কোন দায় নেই?

ছাত্রলীগতো বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছে। ছাত্রলীগ কী সব প্রতিষ্ঠানে খুন করে বেড়াচ্ছে? তা-ই যদি না হয়, বুয়েটে তারা কেন এত হিংস্র হয়েছে? সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি আছে। ছাত্ররা তারা তর্ক করবে, মিথস্ক্রিয়া করবে, স্লোগান দিবে এটা তাদের ধর্ম। কিন্তু খুনী হবে কেন? তার উত্তর কি উল্লসিত বুয়েটের শিক্ষকরা দিবেন?

এই বিশজন ছাত্র বুয়েটে পড়ার আগে বখাটে ছিলনা। তারা বুয়েটে এসে ভুল আচরণে জড়িয়েছে। আমরা তথাকথিত ছাত্ররাজনীতিকে এর জন্য দোষ দিয়ে দায়মুক্তি পাব না। বুয়েটের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি আছে কিনা তা আমাদের দেখতে হবে। বুয়েটের শিক্ষা বলতে নাট বল্টু স্ক্রু খোলা নয়। সেটা কয় মাস গ্যারেজে কাজ করলেও শেখা যায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু৷ এই ছাত্রগুলোর নিশ্চিত ভাল কিছু হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের খুনি বানালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দায় নেই!

সন্তান যখন বড় হয়, বহুমতের সাথে চলে, বহু পথে গিয়ে তারা মিশে, কিন্তু পিতামাতা চলার ও বলার সীমানা কতটুকু তা তাদের শেখান৷ বুয়েটের শিক্ষকরা এসব ছাত্রের পিতা হতে পারেননি, মাতা হতে পারেননি, তারা শুধু সরকারি চাকুরে হয়ে জীবনে কাটিয়ে দিচ্ছেন?

ছাত্ররাজনীতির পরেও একজন শিক্ষক একজন ছাত্রের বাবা মা হয়ে গাইড করতে পারেন৷ তার মননে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেন এটা ন্যায়, এটা অন্যায়। একজন পিতাও এটা করেন। তীব্র চেষ্টার পরেও যখন কোন সন্তান যখন সুমানুষ হতে উঠেন না৷ পিতা তবু হাত ছাড়েন না৷ কষ্ট পান ঠিকই। সন্তানের বখে যাওয়ায়, ফাঁসি হওয়ায় উল্লসিত হন না। বরং সন্তানের পরিনতি দেখে মমতায় কাতর হন, সন্তান মানুষ করতে না পারার ব্যর্থতায় মুহ্যমান হন। পিতা আর শিক্ষকতো একই। কিন্তু এখন সমাজ ব্যবস্থা বোধহয় পাল্টে গেছে, নৈতিকতা পাল্টে গিয়েছে। পিতা-শিক্ষক তত্বও পাল্টে গিয়েছে হয়তো। এখন শিক্ষক আর হয়তো পিতা নন। হলেও বুয়েটে নয়।

"পিতা গড়েন শরীর /শিক্ষক গড়েন মন/ পিতা না শিক্ষক বড় / বলিবে কোন জন!" কবি গোলাম মোস্তফার এই কবিতা বুয়েটের এই শিক্ষকদের জন্য নয়।

লেখক: মনোয়ার রুবেল, কলামিস্ট, ইমেইল: monowarrubel@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর