সৎ-মানুষ হবার মন্ত্র শেখাতে হবে

, যুক্তিতর্ক

এনামুল করিম নির্ঝর | 2023-09-01 21:26:04

আমাদের দেশ বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির স্বাদ পেতে যাচ্ছে। নিজেদের অবস্থানে থেকেই তো মানুষ বিচার-বিবেচনা করে। সেইদিক থেকে আমার মতে আমাদের দেশ আজ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আমদের দেশ এখন সল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হয়েছে। বলা যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা বাণিজ্যিক দিক থেকে এই উন্নয়ন খুবই আশা-জাগানিয়া। কিন্তু আমার মূল আগ্রহের দিকটা হলো, সৃজনশীল মেধার জায়গাটা। আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদারেরা আমাদের দেশের সব সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছিল। পাকিস্তানিরা কেন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে ফেলার নীল নকশা এঁকেছিল? এই প্রশ্নের জবাব তো আমরা সবাই জানি। তাই মেধার দিক থেকেই আমাদের দেশ আজ কতটা এগিয়েছে সেইটাই বিবেচনার বিষয়।  

বেশকিছু বিষয় আছে যেগুলো আমরা লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে শিখি। মানে এটা সাধারণ জ্ঞান। আর বেশকিছু বিষয় আছে যেগুলো আমরা সামাজিক-চর্চা'র মধ্য দিয়ে শিখি। সামাজিক-চর্চা'র মাঝেই সাংস্কৃতিক মননের ব্যাপারটা সুপ্ত থাকে। আমার আগ্রহের জায়গাটা হলো সৃজনশীল মেধার দিকটা। কেননা একটা সময় ছিল যখন সৃজনশীল মানুষ মাত্রই আমরা বুঝতাম সৎ মানুষ। সৃজনশীল মানুষদের একটা সদিচ্ছা থাকে। যার ফলে তাঁরা সততার মাধ্যমে চৈতন্যকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। মানুষকে তাঁরা প্রভাবিত করতে পারে। বুদ্ধির দরোজা তাঁরা খুলে দিতে পারে।

কিন্তু আজকের দিনে আমাদের দেশে যারা বুদ্ধির চর্চা করেন, তাদের অনেকের উদ্দেশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বাসের যে জায়গাটা আমাদের, যে জায়গাটা সততার আর স্বচ্ছতার; সেই জায়গাটাতেই আমরা একেবারেই এগোতে পারিনি। সাদা আর কালোর মাঝে যে তফাৎ কিংবা ন্যায় আর অন্যায়ের মাঝে যে ব্যবধান; এই দিক থেকেই আমরা পিছিয়ে গিয়েছি। এখন তো সব জায়গাতেই 'চোরে চোরে মাসতুত ভাই'র মতন অবস্থা। যখন ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না, তখন তো মানুষ অন্যায় কাজগুলোই নির্বিবাদে করে। ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনাবোধ না থাকাটাই আমাদের বিরাট সর্বনাশ করেছে। যে কারণে আমরা আমাদের সমাজে 'আবরার হত্যা'র মতন ঘটনা ঘটতে দেখছি।

পঞ্চাশ বছর আগে আমরা কেন স্বাধীন হয়েছিলাম? কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? কারণ আমরা কথা বলার স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। মতপ্রকাশের মানে আবার এটা নয় যে, কারো বিরুদ্ধে আমার যা মন চাইলো তাই বলে দিলাম। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যুক্তিসঙ্গত কথাটা ঠিকঠাক বলতে পারা। অথচ বর্তমানে চারদিকে তাকালে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে আমরা যা পাচ্ছি তাই বা আসলে কতটুকু রুচিশীল? কতটুকুই বা সৎ? কিংবা কতটুকু হিপোক্রেসি? এসব থেকেও তো নানানরকম চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। আজকের দিনে এই বিশেষ দিনগুলো; মানে স্বাধীনতা দিবসই বলি কিংবা বিজয় দিবসের কথাই বলি, এগুলো সবই প্রায় লোক-দেখানো হয়ে গেছে।    

২০১৯ সাল থেকে অমর একুশে বইমেলার স্টল সাজানোর কাজটা আমি বিনা-পারিশ্রমিকে করি। এই ব্যাপারটাকে আমি আইএসআর বলি। অর্থাৎ আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে, মেধা দিয়ে দেশকে সেবা দেই। এবং এর বিনিময়ে আমি কোনো পারিশ্রমিক নেই না। চলতি বছরেই সেরা করদাতা হিসেবে ১৪২ জনের মধ্যে আমার নামটিও আছে। ওরা আমাকে এজন্য সম্মাননা দিয়েছে। এর মানে কিন্তু আমি এটা বলতে চাচ্ছি না যে, আমি খুবই ভালো লোক। শুধু বলতে চাচ্ছি, আমার সততার জায়গা থেকে আমি আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি। ব্যাস এইটুকুনই। অন্য কারা কর দিলো কিংবা ফাঁকি দিলো সেসব বিষয়ে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। আমি শুধু সততার জায়গাটার কথাতেই এখানে আলোকপাত করছি। 

স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে এখন আমাদের অন্যতম লক্ষ্যই হওয়া উচিত মেধার বিকাশ ঘটানো এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করা। যারা মুক্তচিন্তার কথা বলে তাদের একজোট হয়ে কাজ করা উচিত। আমাদের দেশের ইতিহাসে আমরা যত পেছনে তাকাবো ততই ঐশ্বর্য খুঁজে পাবো। বিরাট বিরাট ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটেছে এই দেশের মাটিতে। তাই খুব ছোট্ট পরিসর থেকেই মেধার উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। যে শিশুটি আজ কেবলমাত্র স্কুলে পা রাখলো, তাকে সৎ-মানুষ হবার মন্ত্র শেখাতে হবে। আর এই শিক্ষাটা একদম পরিবারের গন্ডি থেকেই শুরু করতে হবে। সকলের মাঝেই সুকুমারবৃত্তি আছে। সেই বিবেকের জায়গাটাকেই উন্নত করতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর কিংবা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী কোনো ছোট বিষয় নয়। এটা ভীষণ এক গৌরবের বিষয়। তাই আগামী প্রজন্মকে মেধার বিকাশে এবং মননশীল মানুষ হতে আমাদের আরো বেশি বেশি উৎসাহিত করতে হবে।     

লেখক- স্থপতি, নির্মাতা ও গীতিকার

এ সম্পর্কিত আরও খবর