তিনি পালাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কেন?

, যুক্তিতর্ক

মাজেদুল নয়ন | 2023-08-30 05:47:40

পুরোপুরি শুদ্ধ না হলেও বর্তমানে দ্রুত কিছু ব্যক্তির মতামত জানতে চাওয়ার প্রধান উপায় হয়ে উঠতে পারে ফেসবুক বা টুইটারের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সম্প্রতি আমিও ফেসবুকে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন? যে উত্তরগুলো এসেছে সেগুলো পরিষ্কার নয়।

আসলে উনি যে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সেটিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে অনুমান করা যাচ্ছে। যেহেতু সরকারের কোন কর্তৃপক্ষ বা তিনি নিজে বলেননি যে তিনি পালাচ্ছেন তাই বলা যায় না, তিনি পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। হয়তো পার্কে ঘুরতে বা কেনাকাটা করতে বা কোন আত্মীয়ের সঙ্গেও দেখা করতে যেতে পারেন! আমরা কিন্তু জানি না।

তবে একজন সংসদ সদস্য তাড়াহুড়ো করে ঢাকা ছেড়ে কানাডায় প্রবেশের চেষ্টা করবেন বা দুবাইতে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হবেন, সেটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পোস্ট থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, তিনি কানাডা যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রবেশ করতে পারেননি। এরপর দুবাইয়ের ভিসা পাননি। ঠিক কি কারণে একটি দেশেও প্রবেশ করতে পারেননি, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। যদি পালানোর চেষ্টা করতেন, তাহলে তিনি অন্য দেশেও যেতে পারতেন। সেটা স্পষ্ট। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে বাংলাদেশের মানুষ ভিসা ছাড়া এবং কোন জটিলতা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারেন।

এছাড়াও করোনা টেস্টের রিপোর্ট ছিল না, কানাডায় প্রবাসীরা আগেই স্থানীয় সরকারকে তার প্রবেশের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন বা তিনি সরকারি পাসপোর্টধারী হওয়া সত্ত্বেও জিও (সরকারি ছাড়পত্র) নিয়ে যাননি, এসব কারণ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে তিনি নিজে কিছু না বলা পর্যন্ত সবই ধারণা নিতে হচ্ছে। কারণ দুবাই বা কানাডার ইমিগ্রেশনও কিছু জানায়নি যে কি কারণে ডা. মুরাদকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।

আবার এই কারণগুলোর যে কোন একটি যদি সত্য হয়, তাহলে তিনি বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা পেরিয়ে দেশের বাইরে গেলেন কিভাবে! সেই প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। তবে এই বিষয়ে একটি মন্তব্য পাওয়া গিয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক তৌহিদুল আহসান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিষয়টি দেখার দায়িত্ব তাদের নয়। তিনি বলেন, বিমানবন্দর দিয়ে যে যাত্রীই বাইরের দেশে যান সেসব বহির্গমন যাত্রীদের স্বাস্থ্য সনদ চেক করা, ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট চেক করার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশনের। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নয়। আমরা ইমিগ্রেশন করি, যাত্রীদের সেবা দেই। ইমিগ্রেশন শাখা ইমিগ্রেশন করবে, স্বাস্থ্যের কাজ স্বাস্থ্য করবে। মুরাদ সংক্রান্ত তথ্য জানতে হলে আপনাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করলে তারা ভালো উত্তর দিতে পারবেন।

দায়িত্বরত এই ব্যক্তির মন্তব্যে বোঝা যায়, আমাদের দেশের বিমানবন্দরটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার নয়। বরং এখানে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থাই বিরাজ করছে এবং সেখানে একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিষয়ে কথা বলার মতো সাহস বা এখতিয়ারও নির্বাহী পরিচালকের নেই।

প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেও ডা. মুরাদ এখনও একজন সংসদ সদস্য। তাই জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং জনগণেরও জানার অধিকার আছে, উনাকে নিয়ে আসলে কি হচ্ছে! এবং তিনি কেন দেশের বাইরে যেতে চেয়েছিলেন!

চলুন সম্প্রতি ডা. মুরাদ হাসানকে নিয়ে আলোচিত বিষয়গুলোকে আমরা বিবেচনায় ধরি। দেখা যাবে, বিএনপি’র মতো একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের পরিবারের একজন নারী সদস্যকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একটি লাইভ আলোচনা অনুষ্ঠানে অশালীন মন্তব্য করেছেন তিনি। তবে এই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই ধরনের অশ্রাব্য ভাষার ব্যবহার নতুন কিছু নয়। অতীতে টেলিভিশনের একটি আলোচিত ও সরাসরি প্রচারিত টকশো’তে ক্ষমতাসীন দলের পুরুষ নেতাকে একই দলের নারী নেত্রীর প্রতি অশ্রাব্য ভাষার ব্যবহার করতেও দেখেছি আমরা। তাই খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কিছু বলায় মন্ত্রিত্ব যাওয়াটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারছে না। আর সেই ঘটনায় বিএনপি বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কোন মামলা করা হয়েছে বলেও শোনা যায়নি।

এই ঘটনার রেশ না কাটতেই কে বা কারা যেন প্রায় ২ বছর আগের একটি অডিও ফাঁস করে দিলেন। যেখানে দেশের একজন নারী অভিনেত্রীর প্রতি নোংড়া ভাষার ব্যবহার করা হচ্ছে অবিরত। কিন্তু এই ঘটনায় না নায়িকা কোন অভিযোগ করেছেন বলে শুনেছি, না শুনেছি ফোনে থাকা নায়ক কোন ধরনের হুমকি ধামকি দিয়েছেন সংসদ সদস্য মুরাদকে। আর যেহেতু অডিও ফাঁস একটি অনৈতিক এবং গুরুতর অপরাধ, তাই এই বিষয়টিও মন্ত্রিত্ব হারানো বা দেশ ছাড়ার কারণ হতে পারছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ছাত্রী হলকে নিয়েও অশ্রাব্য ভাষার ব্যবহার করেছেন তিনি। যেখানে চরম নারী অবমাননা করা হয়েছে। সবকিছু যখন শেষ হলো, তখন এই বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিজ দলের অনুসারী বলে ঘোষণা দেয়াটা বিএনপি মহাসচিবের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

ডা. মুরাদ হাসান যেগুলো করছিলেন, এগুলোর কোন কিছুই কিন্তু এখানকার রাজনীতিতে নতুন নয়। এর চেয়ে বড় বড় অঘটন ঘটিয়েও খোলা মাঠের ওপর আকাশের ছায়া নিয়ে নিরাপদেই রয়েছেন অনেকে। তাহলে উনার মন্ত্রিত্ব যাওয়ার কারণ কি হতে পারে?

আবার যদি উপরোক্ত অভিযোগগুলোর যে কোন একটিও সত্য বলে সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেয়া হয়, তাহলে তার জন্য প্রতিমন্ত্রীর পদ বাতিল নয় শুধু, আইনানুগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচারের আওতায় নেয়ার দাবি রাখে। সেটিও হয়নি। দেশের কয়েকটি স্থানে মামলার আবেদন হলেও আদালত তা খারিজ করেছেন। তাকে গ্রেফতার করার জন্য কোন অভিযান নেয়া হবে, বলেও শোনা যায়নি। বা কোন অশান্ত গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন, তেমন সংবাদও আমাদের চোখে পড়েনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমগুলোতে চলছিল পক্ষে বিপক্ষে তর্ক। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে যখন বোঝা গেলো ডা. মুরাদ হাসানের মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গিয়েছে ক্ষমতার, সঙ্গে সঙ্গে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন দলমত নির্বিশেষে সকলে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতো বেশি ‘বডি শেইমিং (শরীরের আকার বা বর্ণ নিয়ে লজ্জা দেয়ার মতো অপরাধ)’, এতো বেশি ঘৃণা ছড়ানো এবং বুলিং (অপদস্ত করা) হয়েছে উনাকে নিয়ে যেটা সত্যিই অবাক করার মতো। যেগুলো করলে কিনা, এই দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা খেয়ে জেলের ভাত খাওয়ার ভয় থাকে! এক্ষেত্রে কিন্তু এমনটা ঘটছে না। বরং কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন এই আগুনে ঘি ঢেলেই যাচ্ছে!

কিন্তু এই সবকিছুই একজন রাজনীতিবিদের জন্য দেশ থেকে পালানোর কারণ হতে পারে না! তিনি যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে এয়ারপোর্টে ঘোরাঘুরি করছেন, এটা এখানকার প্রচলিত রাজনীতিবিদদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও পড়ে না।

তাহলে কার থেকে পালাতে চাইছেন ডা. মুরাদ হাসান? কেন পালাতে চাইছেন? নাকি গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সকলেই মিথ্যা বলছেন? নাকি ওই অদৃশ্য শক্তি থেকে বাঁচতে চাইছেন তিনি। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সরকারকে বা এই সংসদ সদস্যকেই দিতে হবে।

লেখক: মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর