আমাদের ঘুম ভাঙুক

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ সেলিম | 2023-08-30 05:47:37

পশু জন্মমাত্রই পশু। কিন্তু মানুষ জন্মেই মানুষ নয়। তাকে মানুষ করে তার সংস্কৃতি। সামগ্রিকভারে সংস্কৃতি নির্মাণ করে জনগণ। তার বৌদ্ধিক অংশটাকে নির্মাণ করেন বুদ্ধিজীবীরা। এভাবেই তাঁরা মানুষকে সচেতন করেন। এভাবেই তাঁরা মানুষের চেতনা, মনন আর বিবেককে জাগ্রত করেন।

আমরা সাধারণত: বুদ্ধিজীবী বলতে লেখক, কবি, সাংবাদিক, কণ্ঠশিল্পী, চিত্রশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, নাট্যকার, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, বিজ্ঞানীদেরকে বুঝি। কিন্তু একটি অলিখিত শর্ত থাকে। তিনি যদি তার কর্মের মাধ্যমে সমাজ- সভ্যতা মানুষের চিন্তা- মনন জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখেন তিনিই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী।

এই বুদ্ধিজীবীগণ মূলত: সৃজনশীল। গতানুগতিক ধ্যান ধারণাকে তাঁরা নতুনভাবে দেখতে চান, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। কখনও কখনও অস্বীকার করে নতুন ভাবনার জন্ম দেন। এই নতুন ভাবনা সমাজের বিদ্যমান ভাবনাকে নাড়া দেয়। চিন্তার অচলায়তনের দেয়াল ফুটো করে সতেজ বাতাস প্রবেশের পথ খুলে দেয়। এতে মানুষ জেগে ওঠে, চঞ্চল হয়, আন্দোলিত হয়। রবীন্দ্রনাথের “তাসের দেশ”-এর মত বসন্ত-বাতাস মানুষের মনে মুক্তির নেশা জাগায়।

কিন্তু কায়েমী এস্টাবলিশমেন্ট এটা চায় না। কারণ এতে তাদের শোষণ- শাসনের জগদ্দল কাঠামোতে ফাটল সৃষ্টি হয়। তাই কায়েমী স্বার্থবাদীরা চেষ্টা করে নতুনের কণ্ঠকে রুদ্ধ করার। এ চেষ্টা আজকের নয়।

নতুন কথা বলার জন্য সক্রেটিসকে বিষপান করতে হয়েছিল। ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। গ্যালিলিওকে জীবনের শেষ দিনগুলি গৃহবন্দী অবস্থায় অতিবাহিত করে অন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল।

ধর্মের ইতিহাসেও দেখা যায় নতুন কথা বলার অপরাধে মুসা (আঃ) কে মিশর থেকে পালাতে হয়েছিল। যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল। হজরত মুহাম্মদ (স.) কে জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল।

অথচ পরবর্তীকালে সেইসব ধর্মের ধ্বজাধারীরাই ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করেছে, হত্যা করেছে। এ ক্ষেত্রে সকল প্রতিষ্ঠিত ধর্মই হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যিশু খ্রিস্টকে হত্যা করা হয়েছে ইহুদি ধর্মের দোহাই দিয়ে। ব্রুনোকে হত্যা করা হয়েছে খ্রিস্টধর্মের দোহাই দিয়ে, আর ১৯৭১ এ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে ইসলামের দোহাই দিয়ে।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে ধর্ম নয়, এঁরা কায়েমী স্বার্থকে আঘাত করেছিলেন। কায়েমী স্বার্থবাদীরা ধর্মকে নিজেদের মত করে ব্যবহার করেছে।

পাকিস্তানি কায়েমী ও কওমী চিন্তাধারার মূলে ছিল পূর্ববাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা। তাদের উপনিবেশে পরিণত করা। পাকিস্তানি শাসনের তেইশ বছরের শোষণ-বৈষম্যের পরিসংখ্যান আর অবিচার-অত্যাচার-হত্যা-নির্যাতনের ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী।

পূর্ববাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ প্রথমদিকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাবধারাতেই প্রভাবিত ছিলেন। অচিরেই তাদের মোহভঙ্গ ঘটতে শুরু করে। ধুরন্ধর পাকিস্তানি শাসকরা বুঝতে পেরেছিল এভাবে বেশিদিন বাঙালি শিক্ষিত সমাজকে নেশাগ্রস্ত রাখা যাবে না। তাই তারা এক ভয়ংকর পরিকল্পনা আঁটে।

একটি জাতির প্রাণবায়ু হচ্ছে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হচ্ছে তার শক্তি, তার আত্মপরিচয় আর তাকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করার শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। একটি জাতির সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে সে জাতি পংগু, আত্মবিশ্বাসহীন, বিচ্ছিন্ন ও পরনির্ভরশীল প্রাণীতে পরিণত হয়। তাকে শাসন-শোষণ করা সহজ হয়। কিন্তু হাজর বছরের লালিত মাটির গভীরে প্রোথিত বিপুল বিস্তারিত বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়- এটা বুঝতে পেরে পাকিস্তানিরা সংস্কৃতির বাহন যে ভাষা, সেই বাংলা ভাষাকেই ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। ঘোষণা করে- উর্দুই হবে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

ঘুম টুটে গেল বাঙালি বুদ্ধিজীবীর, ছাত্র জনতার। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন-“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।” ছাত্রনেতা শেখ মুজিব, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, শামসুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত হলো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

তারপর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সাংবাদিকরা পত্র-পত্রিকায় কলামের পর কলাম লিখে বাঙালির জাতীয় চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছেন, শক্তিশালী করেছেন। পাকিস্তানি শোষণ- বৈষম্য সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন। কবি সাহিত্যিকরা তাদের কবিতায়- সাহিত্যে- প্রবন্ধে, চিত্রশিল্পীরা তাদের চিত্রকর্মে, কণ্ঠশিল্পীরা তাদের গানে-সুরে, নাট্যশিল্পীরা তাদের অভিনয়ে, সচেতন শিক্ষকগণ তাদের পাঠদানের মাধ্যমে মানুষের চেতনাকে নির্মাণ করেছেন, যে চেতনা তাদেরকে পরিচালিত করেছে অবধারিত স্বাধীনতার দিকে।

আক্রমণ এসেছে রবীন্দ্রনাথের ওপর। খণ্ডিত করা হয়েছে নজরুলকে। কিন্ত তার ফলে বাঙালি হয়ে উঠেছে আরও সংহত, আরও দুর্জয়।

অন্যদিকে শেখ মুজিবসহ এদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের সুদীর্ঘ সংগ্রাম- কারাভোগ আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিলেন জনগণের অবিচল আস্থা আর ভালোবাসা। এ দুয়ের সম্মিলন আর জনগণের বিপুল আত্মত্যাগের ফলেই এসেছে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

১৯৪৮ থেকে শুরু করে দীর্ঘ তেইশ বছরের আন্দোলনের মূল বাহন ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছেন বুদ্ধিজীবীগণ আর আন্দোলনকে সফলতার দিকে নিয়ে গেছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সে কারণেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি শাসক শোষক আর ধর্মান্ধ মৌলবাদি গোষ্ঠীর চরম শত্রু।

তাই মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস জুড়েই পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। একটি অসম্পূর্ণ গবেষণায় এ পর্যন্ত জানা গেছে- পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন গায়ক শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে।

ধর্মান্ধ শক্তি চেয়েছিল এদেশকে মেধাশূন্য করতে এবং আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখতে। তারা হাল ছাড়েনি, যদিও আমরা স্বাধীনতার পর পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। তারা আবার ঠিকই ফিরে এসেছে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর। তাদেরই প্রতিষ্ঠিত ও সমর্থিত সরকার রাজাকার আলবদরদের পুনর্বাসিত করেছে। গোটা দেশটাকে করেছে ধর্মান্ধ মৌলবাদি শক্তির অবাধ বিচরণভূমি। তারা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বদলে দিয়েছে। একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করেছে। তাদের রোপিত বিষবৃক্ষ আজ সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। সমাজের গভীরে প্রোথিত করেছে তার শেকড়। অন্ধত্বের নেশা ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

তারা আজও একই কায়দায় হত্যা করে চলেছে মুক্তচিন্তার মানুষদের। সমাজকে নির্বিঘ্নে অন্ধতার কূপে আবদ্ধ করার জন্য।

সময় থাকতে এর বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে তীব্র প্রতিরোধ। যদিও সময়ের অনেক অনেক পেছনে চলে গেছি আমরা। সে প্রতিরোধের প্রধান অস্ত্র হবে আমাদেরই আবহমান লালিত অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের। গড়ে তুলতে হবে বিজ্ঞানমনস্ক ও সচেতন একটি নতুন প্রজন্ম।

শুধু বক্তব্য- বিবৃতি আর মানববন্ধন নয়। কাজ করতে হবে সমাজের গভীরে। সারা দেশের প্রতিটি গ্রামে ও শহরে। যেতে হবে মানুষের কাছে। শেখার জন্য, শেখাবার জন্য।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত গণসংগীত শিল্পী, গীতিকার, সুরকার। সহসভাপতি, উদীচী।

আরও পড়ুন: সৎ-মানুষ হবার মন্ত্র শেখাতে হবে

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর