দেশ আজ মেধাশূন্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে: অনল রায়হান

, যুক্তিতর্ক

অনুলিখন: মাহমুদউল্লাহ | 2023-09-01 04:06:45

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অস্ত্র হিসেবে কলম এবং চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছিলেন। তবে সেই স্বাধীনতার স্বাদ তিনি পাননি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ বড় ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। জহির রায়হান ব্যক্তিগত জীবনে অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর সঙ্গে প্রথম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদেরেই সন্তান অনল রায়হান। নিজের বাবাসহ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশ ও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথা বলেছেন এই শহীদপুত্র। 

সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো-

বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেন অনল রায়হান। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন কবি অধ্যাপক, শিল্পী, সাহিত্যিকদের ডেকে নিয়ে গিয়ে যেভাবে হত্যা করে তা ছিলো পূর্ব পরিকল্পিত। এই পরিকল্পনা দেশ ভাগের পর থেকেই শুরু। যেসব সূর্য সন্তানদের তারা এই ৯ মাস ধরে হত্যা করে, তাঁরা কোন ধর্মের লেবাসে বায়াস ছিলেন না। তারা ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার ও মুক্তিকামী। এসব কারণে তারা ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতাশালীদের চোখের কাঁটা।

অথচ দেশভাগ হয়ে ধর্মের উপর ভিত্তি করে। তারা যখন কোনভাবেই এদের বাগে আনতে পারছিলেন না।, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৮ এর গণঅভ্যূত্থান থেকে ৭১ পর্যন্ত এই বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ক্ষমতাশীলদের বিপক্ষে যাচ্ছিল। তাই প্রথম থেকেই এদের চক্ষুশূল ছিলো এসব প্রগতিশীলরা।

১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবী শহীদ হন; তারা কখনই সামান্তবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। তাই আলতাফ মাহমুদ, জহির রায়হানের মতো মানুষকে কোনভাবেই সামান্তবাদীরা বাগে আনতে পারছিলেন না তখন থেকেই শুরু হয় তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র- জানান অনল রায়হান।

নয় মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজাকার আলবদর ও জামাতে ইসলামের নেতাকর্মীররা এই বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে বের করে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেন। পাক সেনারা তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ম্যাসাকারের মাধ্যমে তারা চেয়েছিলো দেশকে মেধাশূন্য করতে। এসব প্রগতীশীল বাঙালিদেরকে হত্যা করে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বাঙালি জাতিস্বত্তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলো। বাঙালি জাতি যেন আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

দেশকে মেধাশূন্য করতে দোসররা অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন বলে মনে করেন এই শহীদপুত্র।

তিনি বলেন, দেশ আজ মেধাশূন্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সেক্টরে তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। প্রতিটি জায়গায় মূল্যবোধের চরম ঘাটতি।

তবে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বিষয়ে অনল রায়হান বলেন, কথা যদি আসে তাহলে প্রাপ্তিটা পরিষ্কার ও বিশাল। সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ নজরুল পর্যন্ত যে প্রচেষ্টা ও প্রতিবাদ। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন। ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাংলার কৃষক শ্রমিকদের আত্মত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি একটি আলদা জাতীয়তা পেয়েছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছে। এ পর্যন্ত ২০০০ বছরের ইতিহাস বাঙালির। একদিনে এই দেশ তৈরি হয়নি। এর ইতিহাস অনেক গভীরে; এটাই অনেক বিশাল প্রাপ্তি।

নিরপেক্ষ সাম্যবাদের মাধ্যমে যদি আমরা দেশকে তৈরি করতে পারতাম তাহলে হয়ত আমাদের আরও বড় প্রাপ্তি যোগ হত। এখনও পৃথিবীর অনেক দেশ বিভিন্ন স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের দেশকে দেখে অনুপ্রাণিত উৎসাহিত হতো। তা আমরা হতে পারিনি। দুর্নীতিমুক্ত, নিরেপেক্ষ থাকতে পারি নি। ধনী-গরিবের বৈষম্য অনেক- এগুলোই অপ্রাপ্তি।

এ থেকে দেশকে উত্তরণের উপায় বলতে আমি মনে করি, একটি সঠিক শিক্ষানীতি, যেখানে একমুখী শিক্ষানীতি থাকবে, মাদরাসার মতো আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না। জামাতে ইসলামীর মতো কোন ধর্ম আশ্রিত দল থাকবে না। তাহলে হয়তো আমরা আরো শক্তিশালি রাজনৈতিক জাতি হতে পারব। রাজনৈতিক উপায়েই এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। দেশে এখন বামপন্থী বলতে কিছু নেই। আওয়ামী লীগই একমাত্র ভরসার রাজনৈতিক দল। তাদেরও অনেক ব্যথর্তাও রয়েছে। আমরা চাইলেই একদিনে ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারব না।

দেশে জামাতের মতো ইসলামী দলগুলো যেন কোন প্রশ্রয় না পায়, তাদের অর্থনৈতিক চেইনও ভেঙে দিতে হবে। তারা কোনভাবে যেন মদদপুষ্ট না হয়, সেজন্য প্রশাসনিক ভাবেও আরো শক্ত হতে হবে। তবেই আগামী প্রজন্ম একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে পারবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর