মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের বুদ্ধিজীবীরা কেমন!

, যুক্তিতর্ক

দেবদুলাল মুন্না | 2023-08-30 11:58:32

বিশ্বইতিহাসে আমাদের দেশ অন্য দেশগুলোর চাইতে বিশেষ করে দুটি কারণে আলাদা। এক ভাষার জন্য লড়াই ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ। অন্যটি হচ্ছে যুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যা। বুদ্ধিজীবী হত্যা একই দিকে ট্র্যাজেডি ও বিউটি ।  ট্যাজেডি কেন পরে বলছি। আর বিউটি হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রাণ ছিল। সক্রিয় ছিলেন। একটা গল্প বলি, গ্রীসীয় ফিলোসফার পলিম্যাথের। পলিম্যাথের ছয় বছরের শিশুটা, স্যামেথ খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। পলিম্যাথ কাজ করছিলেন। কিন্তু তাকে বিরক্ত করছিল স্যামেথ। তখন স্যামেথকে ব্যস্ত রাখার জন্য পলিম্যাথ একটা পত্রিকার এক পৃষ্ঠা কয়েক টুকরো  করে দিয়ে বললেন, সঠিকভাবে জোড়া লাগাও। স্যামেথ ঘটনাক্রমে ওই পৃষ্ঠার উল্টোদিকে একটা মানুষের মুখ দেখেছিল। পলিম্যাথ ভেবেছিলেন , স্যামেথকে এবার দুরুহ কাজ দিয়ে আটকানো যাবে । কিন্তু মাত্র চার মিনিটের ভেতরেই স্যামিথ ওই সাত টুকরো এক পৃষ্ঠার কাগজ হুবহু জোড়া লাগিয়ে বাবাকে চমকে দিল। কীভাবে সম্ভব ? পলিম্যাথ জানতে চাইলে স্যামিথ বলেছিল, মানুষের মুখ জোড়া লাগিয়েছি। এতো অনেক সহজ।

কিন্তু পলিম্যাথ ভাবছিলেন, মুখস্থ না, গতানুগতিক পদ্ধতিতে না, একটা নতুন কাঠামোয় ফেলে এ কাজটি করেছে স্যামিথ। পোস্ট স্ট্রাকচারিলিজমের চর্চা তখন শুরু হয়নি। গল্পটি শেষ। বলার কারণ, বুদ্ধিজীবীদের প্রাণ ও সক্রিয়তা ছিল বলেই তাদের পাক ফ্যাসিস্টরা হুমকি মনে করেছিল। আমাদের দেশেও অনেক বিদ্যাসাগর আছেন। কিন্তু গণবুদ্ধিজীবী নেই। গৌতম ভদ্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,  কালকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে যারাই গ্র্যাজুয়েশন করতেন তাদের সবাইকেই বিদ্যাসাগর বলা হতো একসময়। বিদ্যাসাগর শুধু ইশ্বরচন্দ্র ছিলেন না। তিনি গণবুদ্ধিজীবীই ছিলেন। অনেক সমাজ সংস্কার করেছেন। খালি বই লেখেননি আর পড়েননি।

আমাদের দেশেও বিদ্যাসাগর অনেক। কিন্তু গণবুদ্ধিজীবী সংখ্যায় কম। একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, লাকাপন্থী এক অধ্যাপক যিনি আবার বুদ্ধিজীবী দাবিকারী এমন একজনের সঙ্গে আমার আলাপ হচ্ছিল। তার কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আবদুস সালামের প্রসঙ্গ তুলতেই সেই লাকাপন্থী বললেন, উনাকে কে চিনে ? উনি কি লেখেন? টকশো করেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক? তিনি কেন বুদ্ধিজীবি হবেন?

লাকাপন্থী  একজন একাডেমিশিয়ান ও ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবী। বই পড়া ,লেখা ও বলা তার শুধু কাজ। আর শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আবদুস ছিলেন গণবুদ্ধিজীবী । নড়াইলের কালিয়ায় তার জন্ম। পাবলিক ইনটেলেকচুয়েল। তিনি ছিলেন জুলিয়ান বেন্দার সংজ্ঞায়িত বুদ্ধিজীবীদের মতো না। এলিট অবস্থানে বসে জনগণের মুক্তি চাইতেন না । প্রথমজন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। টক শো করেন। পত্রিকায় লেখেন। কিন্তু জনসম্পৃক্ত কাজে নেই। অন্যদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আবদুস সালাম নিজে একের পর এক স্কুল/ কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ করতেন, বিনা বেতনে গরীব ছাত্রদের পড়াতেন। নিজ এলাকা ছাড়াও ভিন্ন এলাকায় চলে যেতেন যদি তার প্রয়োজন পড়দ সমস্যা সমাধানে।  শিক্ষাকে সচেতনতা-সংস্কৃতির সিডিয়েটর হিসেবে দেখতেন এবং রাজনীতি করতেন জনগণের জন্যে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধও করেছেন । ঘরে বসে বুদ্ধিজীবিতা করেননি। অথচ তিনিও শিক্ষকতা করেছেন। বেটার তবে কে ? একাডেমিশিয়ান বা ট্রাডিশনাল নাকি অর্গানিক নাকি আইডিয়াল বুদ্ধিজীবী নাকি গণবুদ্ধিজীবী?

আন্তোনিও গ্রামসি প্রিজন নোটবুকে লিখেছেন,বুদ্ধিজীবী দুই ধরণের। ট্রাডিশনাল ও অর্গানিক। ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধি বা মেধা বেচেই খান। আর অর্গানিকরা সরাসরি শ্রেণি, উদ্যোগ এবং এককথায় বলতে গেলে উৎপাদন ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা সবসময় সক্রিয় থাকেন। তবে বিশেষ বিশেষ মহলের উদ্দেশ্য রক্ষা করেন। জুলিয়ান বেন্দা দ্য ট্রিজন অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস বইতে বলছেন, সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা হবে অনেকটা যাজকদের মতো, কারণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যা ধারণ করেন তা হলো চিরন্তন সত্য এবং চিরন্তন ন্যায়বিচার- যা এই পার্থিব পৃথিবীর নয়। এগুলো আজ আলাপের  বিষয় না। বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর আমরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে সামনে কাদের মুখ দেখছি সেটি আলোচনা করা। আমাদের ৫০ বছরে জাতীয় অর্জন, সম্ভাবনা ও সংকটে বুদ্ধিজীবীরা কিরকম দায়িত্ব পালন করেছেন এর একটি  ছোট চিত্র খোঁজা। এ জন্য বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে কতোগুলো ধারণা বিষয়ে ক্লিয়ার থাকা। ব্রাকেটে বলি গ্রামসির কথা ধার করে , এক অর্থে সব মানুষ মাত্রই বুদ্ধিজীবী।

দেশ স্বাধীনের পর  সব সরকারের আমলেই  শহীদ বুদ্ধিজীবীদের  তালিকা প্রণয়ন ও কাজ নিয়ে একটা আলস্য দেখা গেছে। সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ১৩ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এতে ১২২২ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অতীতে  প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রীয় কোনো তালিকা এখনও নেই। মজার ব্যাপার আবার তালিকা নির্ধারণের জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীর পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাও নেই। অথচ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজ প্রথমে ১৯৭২ সালে শুরু হলেও, সে তালিকা কখনো সরকারি নথি বা গেজেটভুক্ত হয়নি। এখন যে ১২২২ জনের প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, সেটি গেজেটভুক্ত করা হবে। চলতি বছরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বলেছেন আগামী বছরের ২৬ মার্চের আগে এটি সম্পন্ন হবে। এরমানে ৫১ বছর শেষ হয় কি না সেটি এবার দেখার বিষয়।

বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার কথা  পাকিস্তানী লেখক সেলিম মনসুর খালিদের  উর্দু গ্রন্থ ‘আলবদর ’প্রকাশিত হওয়ার পর জানা যায় যে আলবদররা এক্ষেত্রে সহায়তাকারী ছিল। বইটি বেরোয় লাহোর থেকে জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে, ১৯৮৫ সালে। এ বইতে জানা যায়, বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাদেরই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল যাদের তারা মনে করেছিল ইসলামের শত্রু।  এর কারণ, পাকিস্তান হয়েছিল দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে।  কিন্তু ৫২তে ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানীদের ভাবিয়ে তোলে। কারণ, পাকিস্তানি জাতিসত্তা তথা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা মুছে ফেলতে চাইছিল ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যভিত্তিক সত্তা।

একটা ঘটনা বলি, ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন চলছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকার জো টি নেই।’

সভায় উপস্থিত অবাঙালি শিক্ষাসচিব ফজলে আহমেদ সেদিন রেগে গিয়ে বলেন,   ‘আজ এখানে যেসব প্রবন্ধ পড়া হলো, সেগুলো শোনার পর আমি ভাবছি, আমি কি ঢাকায় আছি না কলকাতায়।’

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী লিখেছেন তার অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে ২০০ বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যবস্থা আমি করেছি। আগের সন্ধ্যায় ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয় এবং ভারতীয়রা ঢাকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সত্য ঘটনা হচ্ছে, ১৭ ডিসেম্বর সকালে অনেক মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, তাই এই হত্যাকাণ্ড নিশ্চয় তারা ছাড়া অন্য কেউ করেছে।’ তবে এটি যে মিথ্যা এটি আবার তিনিই স্বীকার করছেন । লিখছেন,  ‘১০ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের সময় ঢাকার কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ আমাকে পিলখানায় তাঁর দপ্তরে আসতে বলেন। তাঁর কম্যান্ড পোস্টের কাছাকাছি এসে আমি অনেকগুলো গাড়ি দেখতে পাই। বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন, কয়েক মিনিট পর আমি জানতে চাই, এই গাড়িগুলো কেন আনা হয়েছে? তিনি বললেন, “নিয়াজির সঙ্গে সেটা নিয়েই কথা বলতে চাই।” ক্যান্টনমেন্টের হেডকোয়ার্টারের দিকে যেতে যেতে তিনি জানালেন, বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও অগ্রণী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার আদেশ তিনি পেয়েছেন। আমি তাঁকে বলি, কেন, কী কারণে? গ্রেপ্তার করার সময় তো এটা নয়।’ মানে সোজা কথা রাও ফরমান আলী নিজের দোষ আড়াল করতে চাইলেও মুল ঘটনা আড়াল করতে পারেননি।

ভারতের ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার ‘রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র বিরোধী বুদ্ধিজীবী’ ( বাংলা অনুবাদ, এক্ষণ প্রকাশনী) বইতে বলছেন,  পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট বুঝেছিল যে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা জীবিত থাকলে একটা সেক্যুলার রাষ্ট্রের দিকে যাবে।  তাই তারা প্রথম হামলা চালায়  বুদ্ধিজীবীদের ওপর। শেষ হামলা চালায় বুদ্ধিজীবীদের ওপর। একটা জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু করাই এসব হামলার উদ্দেশ্য ছিল। দ্বিজাতি তত্ত্ব হেরেছিল ভাষা আন্দোলনের কাছে। আর  রিলিজিয়ন বেইসড রাষ্ট্র হেরেছিল ৭২ এর সংবিধানের কাছে। বাংলাদেশে বেঙ্গলস ইন্টেলেকচুয়াল ( যারা উর্দুভাষী এলিট  শিক্ষিত মুসলিম) রা বাংলা চাননি। চেয়েছিলেন বাঙালি ( বাংলাভাষী তুলনামুলক পিছিয়ে পড়া ইন্টেলেকচুয়াল) বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ। আবার দেখা যায়,  যাদের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর একাংশ  আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কম্যুনিস্ট চীনের ভূমিকার জন্য ১৯৭১ সালে এই যুদ্ধে দুরে ছিলেন। কারণ ওই যে  ১৯৭১ সালে পাক-চীন-মার্কিন সখ্যতা।আবার একদল বুদ্ধিজীবী দুর্গম পথ অতিক্রম করে মুজিবনগরে গিয়েছিলেন, তারা প্রবাসী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। অন্যদিকে  আরেকটি শ্রেনী সরকারি চাকরি করেছেন যদিও গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছিলেন  ফলে সেসময়ে বিভিন্নধরণের বুদ্ধিজিীবীতা দেখা যায়। ওই যে শ্রেনীচরিত্র ও রাজনৈতিক অবস্থানের ওপরে বুদ্ধিজীবীতা যায় না এর প্রমাণ তখনও মিলেছে। অমলেন্দু দে’র একটি বই পড়লাম সম্প্রতি। নাম, বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ। বইতে তিনি বলছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার পরই বুকাননের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮০৬ ও ১৮০৭ সালের মধ্যে যে মধ্যস্বত্তভোগী শ্রেনীর আবির্ভাব ঘটে সেসময় থেকেই বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা কৃষকের জন্য ভুমি ব্যবস্থার ব্যাপারে বড়ো কোন প্রতিবাদ করেনি। কারণ তখন হিন্দুদের দখলে ছিল ভুমি বেশি। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন চুপ।

এরই যেন প্রতিশোধ নিতে চেয়েছেন বেঙ্গলস বুদ্ধিজীবীরা ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যারা পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের শুরুটা আঠারো শতকেই। মানে এই বিচ্ছিন্নতাবাদে রাজনীতি ও ধর্মের ব্যবহার কাজ করেছে।

তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সচেতনতা ও বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ যতো বৃদ্ধি পাচ্ছিল ততোই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ততো বেশি চেষ্টা করা হয়েছে তাদের প্রলুব্ধ করার। বুদ্ধিজীবীদের পেছনে আর্থিক বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠান গড়া হয়েছে, পুরস্কার পারিতোষিকের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছিল। অনেকে সেইসব প্রলোভনে পা দিয়েছেন অনেকে দেননি। যারা দেননি তারাই মুলত উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে গিয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ প্রবন্ধে বলছেন, একসময় ধর্ম ছিল ঐক্যের বন্ধন, এখন সেখানে এলো ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারির পর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী যখন দেশের কথা বলছেন, ‘ তখন অধিকাংশ সময় তাঁরা আসলে বাংলাদেশের কথাই বলেছেন, পাকিস্তানের কথা নয়। দেশপ্রেম তাঁদের দেশদ্রোহী করেছে- এক অর্থে। বায়ান্নর পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মমতার ক্ষেত্রে, চর্চার ক্ষেত্রে বান ডেকে জোয়ার এসেছে। রচনার উৎকর্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক পরিমাণে। এর ফলে শুধু যে ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে তা নয়, মানুষের মধ্যে ঐক্যের বোধ বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা, বেড়েছে সুন্দরতর জীবনের প্রতি আকর্ষণ। বাইরে যাই বলুক, পাকিস্তানের শাসকরা একুশে ফেব্রুয়ারি শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিল, তাই গণহত্যা শুরু করেই তারা ছুটে গিয়েছিল শহীদ মিনারের দিকে, মিনারকে ভেঙে দিয়ে আক্রোশ মিটিয়েছিল তারা। আর মিনারের জায়গায় মসজিদ তৈরি করে তারা তাদের পুরাতন কৌশল নতুন করে প্রকাশ করেছিল : কৌশলটা হলো ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে বিক্ষোভকে স্তিমিত করা ‘

আমি যতীন সরকারের কাছে কয়েকবছর আগে জানতে চেয়েছিলাম, এখন আমাদের দেশে গণবুদ্ধিজীবী কারা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তার জানা নেই। কারণ বুদ্ধিজীবীরাও এখন পার্টিজান। বিভিন্ন ফোরামে বিভক্ত।দলভিত্তিক বুদ্ধিজীবী থাকলেও জনমুখী বুদ্ধিজীবী নেই। আরেকটি কারণ এখন সব দলই রাজনীতির জন্য ক্ষমতার জন্য রিলিজিয়নকে ব্যবহার করে। ফলত, বুদ্ধিজীবীরাও  সুবিধা বোঝে সরব নীরব থাকেন। এজন্যই বুদ্ধিজীবী ‘গালি’তেও রুপান্তরিত হয়েছে।

আহমদ ছফা তার ‘বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতা নিয়ে আলোচনা করে বলেছিলেন,‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না ।’ তিনি তখনই বলেছিলেন ‘ এখন যা বলছেন সেটা শুনলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটবে না৷’

ছফা মনে করতেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই সুবিধাবাদি৷ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে তারা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি ব্যয় করতে আগ্রহী নন৷ অথচ এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে শুরু করে নোয়াম চমস্কি মনে করেন বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট বার্তা। সত্য প্রকাশে ভয়হীন। বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের মিথ্যাগুলোকে জনগণের সামনে উন্মোচন করা৷ কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য বুদ্ধিজীবীরা এখন কি সবকিছু বলতে পারছেন ? এদেশে স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে পারছেন? কারণ ডিজিটাল আইনসহ বেশ কিছু নিয়ন্ত্রিত বিধিব্যবস্থাগত চাপের কারণে অনেকেই কথা বলতেও কৌশলী। নোয়াম চমস্কি  ২০১৭ সালে লেখা Requiem for the American Dream: The Principles of Concentrated Wealth and Power জানাচ্ছেন বিভিন্ন দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্পোরেশন হয়ে পড়ছে। গবেষণার জন্যও যে ফান্ডিং করা হয় সেসব প্রতিষ্ঠানও সরকার বা পশ্চিমাশক্তির মদদপুষ্ট। ফলে ভিন্নচিন্তা-বিচিন্তা-প্রতিচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের সীমাহীন ভয় কী বললে কী যে পরিণতি হয় না হয়!ক্রেইগ ম্যুর ও একই আশংকা করেছেন। আর স্লাভায় জিজেক তো রসিকতা করে বলেছেন, বুদ্ধিজীবী জন্মানোর সুযোগ না দিলে বুদ্ধিজীবী জন্মাবে না , হত্যা করারও দরকার পড়বে না।

এখন বুদ্ধিজীবীদের কেউ ইস্যুভিত্তিক মুভমেন্টের পক্ষে। কেউ নির্বিশেষ মুভমেন্টের পক্ষে। ক্ষমতার চর্চাকারীরাও বর্গীকরণের ফাঁদ হাজির করে রাখছেন। ফলে দেশ কোন পথে এগুবে এ ব্যাপারে গণবুদ্ধিজীবীরা এখন মাঠে থাকলেও কিছুটা অসহায়। বাজার রমরমা একাডেমিশিয়ান , ট্রাডিশনাল, অর্গানিকদের। প্রতিটি সরকারেরই বোঝা উচিত স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা। গ্রহণ করা না করা সেটা সরকারের ব্যাপার। কিন্তু বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করলে অন্তত সরকারের বুঝতে সুবিধা হবে  কে কি বলছে, কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। কোনপথে দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা পাবে। একটা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করেন গণবুদ্ধিজীবীরাই। অন্যরা নন। বিদ্যাসাগররা তো ননই। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদও বিদ্যাসাগরই ছিলেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর