মীরজাফর!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 20:59:45

'মীরজাফর' একজন ব্যক্তি হিসাবে নাউন বা বিশেষ্য। আবার খলতার অভিধা হিসাবে 'মীরজাফর' বিশেষণ। একজন ব্যক্তির নাম যা-ই হোক না কেন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তিনি মীরজাফর হতে পারেন। কেবল ১৯৫৭ সালেই নয়, কালে কালে বহুজন মীরজাফর হয়েছেন এবং হবেন।

বাংলার রাজনীতির আদি যড়ষন্ত্রের অন্ধি-সন্ধি সম্পর্কে জানতে হতভাগ্য শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ, আগ্রাসী দখলদার রবার্ট ক্লাইভের পাশাপাশি যড়ষন্ত্রী মীরজাফরকেও সম্যকরূপে জানা জরুরি।

কিন্তু নবাব সিরাজের একাধিক জীবনী আছে। ক্লাইভেরও মস্ত বড় জীবনচরিত রচিত হয়েছে ইংরেজ ও ইংরেজ অনুগত লেখকের হাতে। অথচ মীরজাফরকে নিয়ে গবেষণা বা জীবনীগ্রন্থ আছে বলে জানা যায় না। ফলে একজন মীর জাফর আলী খান, কেন এবং কি কারণে কুখ্যাত মীরজাফর হয়ে উঠলেন, সেটা প্রায়শই অস্পষ্ট থাকে। কি পরিস্থিতি এবং কাদের প্ররোচনায় একদার বীর সেনাপতি মীরজাফরে রূপান্তরিত হলেন, তা অজানা থেকে যায়।

বর্গি-মারাঠা হামলাকারীদের দমন ছাড়াও বিভিন্ন যুদ্ধে মীর জাফর আলী খান লড়েছিলেন। নবাব আলীবর্দি খানের বিশ্বস্ত অনুচরদের অন্যতম ছিলেন এই সেনাপতি ও আত্মীয়। কিন্তু আলীবর্দি খানের মৃত্যুর পর তরুণ সিরাজ নবাব হলে আগের সেই মীর জাফর আলী খানকে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় এক ঘৃণ্য যড়যন্ত্রী মীরজাফরকে।

অতএব কোন্ প্রেক্ষাপটে, কি কারণে এবং কাদের প্ররোচনায় তিনি নিন্দিত মীরজাফরে পরিণত করলেন নিজেকে, এসব প্রশ্নের উত্তর না জেনে তার বা তার কার্যক্রম সম্পর্কে পুরোটা জানা অসম্ভব। জগৎশেঠ, রায় বল্লভদের না জানলে মীরজাফরকে জানা হয় না। এটা জানা এজন্যই জরুরি এই কারণে যে, বিশেষ প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে যে কোনও মানুষই মীরজাফর হয়ে যেতে পারেন। এমনটি ব্রিটিশ আমলে যেমন হয়েছে, আজকেও হওয়া সম্ভব। এজন্য সিরাজ বা ক্লাইভের মতো মীরজাফরের জীবনীও জানা জরুরি, যা থেকে কোনও মানুষের মীরজাফরে রূপান্তিত হওয়ার প্রবণতা সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া সম্ভব হতে পারে।

মীরজাফরের কোনও জীবনী না থাকলেও সদ্যজাত একটি নাটকে মীরজাফরকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করা হয়েছে। কলকাতার ব্রাত্য বসুর মীরজাফর নাটক দেখতে গিয়ে গিরিশ মঞ্চে বহু কমবয়সি ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে, যারা মীরজাফর সম্পর্কে জানতে চায়, এমনটিই সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

জানা যাচ্ছে, তরুণ দর্শকরা ঝকঝকে। শুধু স্মার্ট ফোন নয়, মুরাকামির উপন্যাস এবং মাজিদ মাজিদির সিনেমা নিয়েও এরা ওয়াকিবহাল। আবার ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট পলিটিক্স থেকে কর্পোরেট কালচারের খুঁটিনাটিও শিখে ফেলছে। এরা মীরজাফর দেখে মুগ্ধ হয়েছে বলেও মিডিয়াকে জানিয়েছে।

কেন তারা মুগ্ধ? কী আছে মীরজাফরে?‌ তা জানতে নাটকের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়।  'আজকাল' পত্রিকার পুজাসংখ্যায় ব্রাত্য বসুর নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিল। নাটক না দেখলেও নাটকটি আমি পড়েছি। নাটকের ব্যাপক জনপ্রিয়তার খবর পেয়ে আমি আবারও সেটি পড়ি।

নাটকের কাহিনী নিয়ে বেশি বলার কোনও মানে হয় না। পলাশীর যু্দ্ধের পরের সাত বছরের বাংলার ইতিহাস এতে আছে। সিরাজকে সরিয়ে মীরজাফর বাংলার সিংহাসনে বসলেন। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থাবা। এই হল প্রেক্ষাপট। মূলত দুজনের গল্প। মীরজাফর এবং লর্ড ক্লাইভ। সিরাজ তখন অন্তরালে। জগৎশেঠ, রায় বল্লভদের পোয়াবারো। সে সময় তাদের লোভ, লালসা, ক্রূরতা, জয়, পরাজয়ের গল্পটিই নাটকে বলা হয়েছে। মানব চরিত্রের গহিনের অন্ধকারে আলো ফেলতে ফেলতে ভয়ে, বিস্ময়ে, চমকে উদ্ভাসিত হয়েছে ইতিহাসের  নির্মমতা।

কিছুদিনের জন্য বাংলায় ‘‌মীরজাফর জিন্দাবাদ’ শ্লোগান উচ্চারিত হলেও কালের বিচারে তা নিভে যায়। দৃশ্যপটে আসে ক্লাইভ প্রমুখের প্রকৃত উপস্থিতি। মূল যড়ষন্ত্রের জায়গাটিতে পৌঁছার আগে মীরজাফর আসলে অন্তর্বতীকালীন কুহেলিকা। এই সত্যের বয়ানে ইতিহাস থেকে থিয়েটারটি লাফ দিয়ে স্পর্শ করেছে 

সমকালীন বাস্তবতা। এখানেই মানুষের আগ্রহ। এখানেই চারপাশে মীরজাফর এবং পেছনের প্রকৃত যড়ষন্ত্রীগণের ছবি দেখতে পেয়ে নতুন প্রজন্ম উদ্বেলিত।

মীরজাফর আসলে শুধু নিজেকে দেখান না, চারপাশে লুকিয়ে থাকা আরও অনেক মীরজাফরকে উন্মোচিত করেন। আমাদের কালে, আমাদের আশেপাশে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা বিষধর মীরজাফর গং সম্পর্কে জানান ইতিহাসের মীরজাফর। অতীত ইতিহাসের মীরজাফর যড়ষন্ত্রকারীদের একজন আর বর্তমানে মীরজাফর আমাদের ঘিরে যড়ষন্ত্রের কালো-কুটিল-বিশাল চক্রব্যূহ সম্পর্কে জানার এক মাধ্যম। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর