গালির সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-09-01 07:46:48

আমি যে এলাকায় থাকি সেই এলাকায় বয়স্ক এক ভদ্রলোক থাকেন। শুনেছি চাকরি জীবনে দাপুটে কর্মকর্তা ছিলেন। অবসরের পর সেই দাপটের কিছুটা প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োগ করার চেষ্টা চালান। রিকশাচালকদের সাথে ভাড়া নিয়ে বাক-বিতণ্ডা করা তার দাপটের অন্যতম একটি অংশ। এমনই একদিন তার বাসার সামনে ভাড়া নিয়ে এক রিকশাচালকের সাথে তুমুল বিতণ্ডা চলছে। গরমের সময়। রিকশাচালক ঘামে ভিজে অস্থির। তার মধ্যে ভাড়া কম-বেশি দেওয়া নিয়ে এই ঝামেলা। ভদ্রলোক রিকশাচালককে বিভিন্নভাবে ধমকানোর এক পর্যায়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেই ফেললেন, ‘স্কাউন্ড্রেল, তুই চিনস আমারে?’ রিকশাওয়ালাও সাথে সাথে বলল, ‘হ চিনি, আপনি আমার পু.. (গালি)’।

এই কথা শুনে ভদ্রলোক স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হলো না। যে বিষয়ের সাথে রিকশাওয়ালা তাকে তুলনা করল তা সে চিন্তাও করতে পারেনি। ‘পু..’ নামক মানব অঙ্গের সাথে কোনো মানুষের তুলনা করা যায় কিনা সেটা ভাবনার বিষয় হতে পারে। তবে রেগে গেলে অনেক কিছুরই সাথে আমরা মানুষকে তুলনা করি। আমাদের সংষ্কৃতিতে যেগুলো গালি হিসেবে পরিচিত। আবার অনেক সময় ক্ষমতা দেখাতে, তাচ্ছিল্যভরে বা মজা করেও অনেক কিছুর সাথে মানুষকে তুলনা করা হয় যা গালি হিসেবে বিবেচিত।

গালির আভিধানিক অর্থ কটু বা তিরস্কারপূর্ণ শব্দ বা বাক্য। কুৎসিত বা অশ্লীল শব্দ বা বাক্যও গালি হিসেবে বিবেচিত যা প্রায়শ মানব সম্প্রদায়ের অনেকেই ব্যবহার করেন। গালির ইংরেজি অর্থ স্ল্যাং, ল্যাঙ্গুয়েজ, ইনফরমাল ওয়ার্ডস বা ভারবাল ভায়োলেন্স। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই এমন কিছু শব্দ রয়েছে যা গালি হিসেবে প্রয়োগ বা ব্যবহার করা হয়। গালি সংক্রান্ত গবেষণা, গ্রন্থ, প্রবন্ধ, নিবন্ধের সংখ্যাও কম নয়। ভাষা ও সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগেও গালির প্রয়োগ এতটুকু কমেনি। পুরুষ, নারী, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনি, গরিব নির্বিশেষে গালি দেবার ও গালি খাবার দৃষ্টান্ত আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে ও দেখতে পাই।

বলা হয়ে থাকে ভাষার আবিষ্কার মানুষের এক অনন্য আবিষ্কার। ভাষার ব্যবহার মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে। মানুষ একে অপরের সাথে পরিপূর্ণ ভাব বিনিময়ে সক্ষম হয়েছে ভাষার কল্যাণে। বিভিন্ন বিষয়ে ভাব বিনিময়ের কারণে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠেছে সামাজিক সম্পর্ক। সামাজিক সম্পর্কের দ্বারা তারা গড়ে তুলেছে গোষ্ঠী, সমাজ, সংগঠন ও রাষ্ট্র। মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভাষার অবদান অনস্বীকার্য। ভাষার আবিষ্কার না হলে মানব সভ্যতা এতো উৎকর্ষ লাভ করতে পারত না বলে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। ভাষার ব্যবহার করেই মানব সম্প্রদায়ের কেউ হয়েছেন বিখ্যাত, জাতিগতভাবে উন্নত। ভাষায় হলো মানুষের প্রধান হাতিয়ার যা ব্যবহার করে সে তার নিজেকে প্রকাশ করেছে, রেখে গেছে তার অমূল্য চিন্তাভাবনা এবং অর্জন করেছে কীর্তিমানের খেতাব।

ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে পৃথিবীতে সাত হাজারেও বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। কীভাবে এতগুলো ভাষার সৃষ্টি হলো বা কীভাবে ভাষার ক্রমবিকাশ ঘটল তা নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে মত-পাথর্ক্য আছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ দর্শন, চিন্তা ও বিশ্বাসের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। ভাষার মূল চালিকা শক্তি শব্দ। বিভিন্ন শব্দের সমাহার ভাষাকে উন্নত করে তোলে। ভাষা সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধমে ভাষার ক্রম উৎকৃষ্টতা ও শ্রেণিবিন্যাস ঘটেছে। নতুন নতুন শব্দের সংযোজন এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। কোনো ভাষায় উন্নত শব্দ যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে তেমনি নিকৃষ্ট কিছু শব্দেরও উৎপত্তি ঘটেছে যা সংস্কৃতিভেদে খারাপ বা অশালীন অর্থে প্রয়োগ করা হয়। পণ্ডিতেরা বলেন, এইসব শব্দ মূলত কোনো সমাজ বা সংষ্কৃতিতে যে বিষয়গুলো খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয় বা যে বিষয়গুলো সমাজের মানুষেরা আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না সেসব বিষয়ের শব্দই গালি হিসেবে প্রযোগ করা হয়। অর্থাৎ এসব শব্দ বা বাক্যে মানুষ এক ধরনের ‘ট্যাবু’ আরোপ করে। সুতরাং কাউকে গালমন্দ করতে উক্ত শব্দ বা বাক্য ব্যবহৃত হয়।

বিভিন্ন ভাষায় এমনই কিছু ট্যাবু শব্দ রয়েছে যা গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গালি মানুষের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, গালি ভাষা-নির্ভর নয়, সংস্কৃতি-নির্ভর। যে কারণে এই গালির প্রকার ও ধরন সমাজ, স্থান ও সময়ভেদে ভিন্নতর হয়। গালির মাধ্যমে ইতিবাচক ও নেতিবাচক সামাজিক সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটে বলে অনেকেই মনে করেন।

বাংলাভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যা গালি হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার অনেকেই বিদেশি শব্দও গালি হিসেবে ব্যবহার করে। উল্লেখ্য সমাজের উঁচু-নীচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষই কমবেশি গালির প্রয়োগ করে থাকে। ব্যক্তি, স্থান, কাল ও পাত্রভেদে গালিও বিভিন্ন প্রকার হয়। সমাজের উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণি, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের গালিও প্রায়ই ভিন্ন হয়।

মানুষ কেন গালি দেয় তা নিয়েও রয়েছে অনেক বিশ্লেষণ। বিবিসি’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অপরকে গালি দিয়ে মানুষ এক ধরনের সুখ পাই (গালি দিয়ে আমরা এত সুখ পাই কেন? বিবিসি.কম, ৬ মে, ২০২১)। অনেকের মতে, মানুষের রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের অন্যতম কার্যকরী মাধ্যম হলো গালি। কারো ওপর রাগ হলে মানুষ গালিগালাজ করে মনকে হালকা করে বা মানসিক উত্তেজনা প্রশমন করে। এক্ষেত্রে গালি ঔষধের কাজ করে। আবার অনেকেই বলেন, গালি হলো অক্ষম মানুষের অস্ত্র। যখন কোনো মানুষ শারীরিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিতে অন্য কারো সাথে পেরে ওঠে না তখনই সে খারাপ ভাষা বা গালি দিয়ে থাকে।

তবে গালি নিয়ে সমাজের শিক্ষিত মহলে বেশ অসন্তোষ দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, আইন করে গালি নিষিদ্ধ করা উচিৎ। কারো কারো ধারণা, গালি ভাষার সৌন্দর্য ও পবিত্রতা নষ্ট করে । সুতরাং তা ভাষা থেকে ছেঁটে দেওয়া উচিৎ। গালি অবশ্যই সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে; কিন্তু ভাববার বিষয় হলো, মানুষ অনেক সভ্য হয়েছে, সভ্যতা বেশ ভাবনা-চিন্তা করে আজকের অবস্থায় এসেছে। অথচ গালির বিলুপ্তি ঘটানো সম্ভব হয়নি, বরং ক্ষেত্রবিশেষ যুগে যুগে এর নতুন উপযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন গালি।

সুতরাং, বলা যায় গালির প্রয়োজনীয় দিকটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গালি না থাকলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হতো তা হলো, মানুষে মানুষে দৈহিক হাঙ্গামা বা শারীরিক সংঘর্ষ বেড়ে যেত বহুগুণে। মানুষ ভাষা বা অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে রাগ মেটাতে না পেরে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। গালির মাধ্যমে যে কাজটি সহজেই হয়ে যায়, সেই কাজটি করতে লাঠি চালাচালি হতো। বিশৃঙ্খলা বেড়ে যেত কয়েকগুণ। তবে গালিও যে অনেক সময় বিশৃঙ্খলা, দৈহিক আক্রোশ ও হাঙ্গামার কারণ হয় তারও অসংখ্য নজির রয়েছে। গালির মধ্যে অশ্লীলতার কারণে অনেকেই এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু গালির মধ্যেও যে সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব রয়েছে তা উপেক্ষা করার উপায় নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর