পানিতেও অগ্নিমৃত্যু- এ নরকযন্ত্রণার দায় কার?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-29 18:16:38

জন্ম নিলেই জীবমাত্র মৃত্যুবরণ করার গ্যারান্টি লাভ করে। একথা কোন জীবেরই অস্বীকার করার উপায় নেই-যে তাকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। এটা প্রকৃতির অমোঘ বিধান।

মৃত্যুর একটা নিজস্ব রূপ আছে, স্বরূপও বিদ্যমান। যেটা কখনও কাঙ্খিত, কখনও স্নিগ্ধ-সুন্দর। সবাই যেটা স্বাভাবিক ভেবে মেনে নেয়। যে রূপটা কারো বা কিছু পুন্যাত্মার নিজের বা আপনজনদের পছন্দ হলেও মৃত্যুর স্বরূপটা সবার জন্য ভয়ংকর। সেজন্য এ স্বরূপকে কেউই পছন্দ করে না। এমনকি স্মরণ করতেও বিরক্ত বোধ করে করে। স্মরণে আসুক বা কেউ স্মরণ করুক সেটাও অনেকে অপছন্দ করে।

কারণ, দুনিয়াতে যত ধরনের ভয় আছে তন্মধ্যে মৃত্যুভয় হলো সবচে’ বড় ভয়। নিজের মৃত্যু অবধারিত জেনেও অনেকে তা নিয়ে ভাবতে চান না। স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যে প্রকারেই আসুক না কেন মৃত্যুদূত হাজির হলে কারো কিছুই করার থাকে না। তবে অস্বাভাবিক ও কষ্টদায়ক বা হৃদয়বিদারক মৃত্যুকে মেনে নিতে সবারই কষ্ট হয়।

ডিসেম্বর ২৩ তারিখে রাত তিনটার সময় ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে নলছিটির দপদপিয়া এলাকায় এমভি অভিযান লঞ্চে অগ্নিকান্ডে ৪০ জন যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাতাসে পোড়া গন্ধে সুগন্ধার নামটি যেন ভয় ও দুর্গন্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে সবার মনে। ইঞ্জিন রুমে থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে খবরে জানানো হয়েছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন এই লঞ্চের ইঞ্জিন নষ্ট ছিল। গর্জন করে মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যেত। আগুন লাগার পর এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী এর অগ্নি নির্বাপন ব্যাবস্থা কোন কাজে আসেনি। ইঞ্জিন রুমে বিকট শব্দের পর শত শত লিটার জ্বালানিতে ভরা ট্যাংকে আগুন ধরে গেলেও তার নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ফলে সহজেই গোটা লঞ্চে খুব দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।

ঢাকা থেকে লঞ্চটি বরগুনা যাচ্ছিল। এর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৭৬০ জন। রাতের ভ্রমণে ঢাকা থেকে ৪২০ জন যাত্রী উঠলেও চাঁদপুর থামলে এত লোক উঠে যে লঞ্চটিতে তিল ধরনের ঠাঁই ছিল না। আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেলে লঞ্চের মাস্টার, সারেং, সুকানী সহ ২৫ জন স্টাফ পালিয়ে যায়। (জাগোনিউজ২৪.কম ২৪.১২.২০২১)।

আগুন লাগার পরও ৩০-৪০ মিনিট লঞ্চটি চালিয়ে নদীর পাড়ে ভেড়ানো হয়। যাত্রীরা পানিতে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। একজন যাত্রী সন্তান হাতে নিয়ে নদীতে লাফ দিয়েছিল। প্রিয় সন্তান হাত থেকে খুলে গেছে, সংগে স্ত্রীও তলিয়ে গেছে। তাদের কারো সন্ধান মেলেনি। তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আহাজারি করে চলেছেন। তবে কেবিনে ঘুমিয়ে থাকা যাত্রীরা কেউ আগুন টের পাবার আগেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছেন! কেবিনে গিয়ে উদ্ধারকারীরা পোড়া কঙ্কাল ও খুলি খুঁজে পেয়েছেন।

নদীতে ফায়ার ব্রিগেড দ্রুত অকুস্থলে পৌঁছাতে পারে। এছাড়া প্রতিটি নৌযানের নিজস্ব ব্যবস্থায় দ্রুত আগুন নেভানোর ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু অভিযান-১০ লঞ্চের জরুরি এলার্ম বা ঘন্টা বাজেনি, নিজস্ব অগ্নি নির্বাাপণ ব্যবস্থা কেন ব্যবহার করা হয়নি বা ছিল কি-না তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সাইরেন বা এলার্ম না বাজায় কেবিনের যাত্রীদের ঘুমও ভাঙ্গেনি।

পানির উপরে বসে এমন মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডে পুড়ে মরার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

দু’বছর আগে বনানীর সুউচ্চ ভবন থেকে আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে নিপতিত হওয়া অসহায় মানুষের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়া, ডিশের তার ধরে মাটিতে নেমে আসার বৃথা চেষ্টা করা মানুষগুলোর ছবি নিছক কোন ছবি ছিল না। ছবি হলেও সেগুলো আমাদেরকে বার্তা দিয়েছে- ভয়ংকর কিছুর। এটা মেনে নেয়া যায় না। এটা কাঙ্খিত, স্নিগ্ধ-সুন্দর মৃত্যু নয়। কেন এমন হয়? এমন হতে থাকলে আমাদের কি কোন করণীয় নেই?

সবসময় ঘটনা ঘটার পর প্রতিকার করতে লাফিয়ে উঠি কিন্তু আগেই প্রতিরোধ করি না কেন? আমরা এ ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই সতর্কতা নিই না কেন? আগুন লেগে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবার পর কুম্ভকর্ণের মত আমাদের সবার ঘুম ভাঙে। এটা একটা মারাত্মক দেউলিয়াপনা। যা বার বার সম্পদহানি ও আগুনেমৃত্যু সংঘটিত করে অনেকের জীবনে চিরন্তর ভোগান্তি বয়ে আনছে।

প্রতিদিন বাস, রেল নৌ, বিমান কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা হচ্ছে। কিন্তু সবচে’ ভয়ংকর দুর্ঘটনার নিদর্শন- নিমতলী ট্রাজেডী, চুড়িহাট্টা অগ্নি বিপর্যয়, বনানীর আগুন, গুলশান কিচেন মার্কেটের আগুন। ভয়ংকর সেসব দুর্ঘটনা। কেউ কেউ এগুলোকে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। কেউবা বলেছেন এগুলো হত্যাকান্ড। অবহেলার ফলে এই নির্মম হত্যাযঞ্জ ঘটেছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এভাবে অনেক কঠিন-করুণ শিক্ষা হলেও আর কত?

বনানীর আগুনে ৮ম তলায় এক বন্ধুর ১২ জন সহকর্মী একসংগে প্রাণ হারিয়েছে। সেখানে তিনজন মহিলা সহকর্মীও পুড়ে অঙ্গার! একজন সহকর্মী বাথরুমে ছিল। সেটা কেউ জানতো না। অজান্তেই ওকে ছেড়ে সবাই নেমে এল। কিন্তু সে আর নিচে নামতে পারেনি। কি মর্মান্তুদ ঘটনা! সেখানে জরুরি এলার্ম বা ঘন্টা বাজেনি, জরুরি ফায়ার এক্জিটগুলো ছিল তালাবন্ধ। সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হলেও এর দায় নেবেটা কে? শুধু সামান্য ক্ষতিপূরণ দেবার ঘোষণা দিয়েউ কর্তৃপক্ষ দায় সেরেছিল।

অভিযান-১০ অগ্নিকান্ডে এবারও তাই। জেলা প্রশাসন ২৫ হাজার টাকা দেবে বলেছেন। নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এই অগ্নি দুর্ঘটনায় নিহতদের পতিজনের পরিবারকে দেড় লক্ষ টাকা দেয়া হবে। শুধু টাকাই কি সব? দেশে সড়কে নিরাপত্তা নেই। কিন্তু এখন সড়কের চেয়ে নৌপথই বেশী বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ নৌযানকে ঘঁেষে -মেজে অবৈধভাবে পারমিট প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রতিটি নৌযান ছাড়ার পূর্বে সেগুলোর ফিটনেস চেকআপ করার জন্য লোকবল নিয়োগ করা থাকলেও তারা দায়িত্বে অবহেলা করে থাকেন। পরে অচল বাহন সচল বলে চালিয়ে দেয়া হয। এছাড়া চাঁদপুরে থামার পর স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অতিরিক্ত ঠাঁসা যাত্রী তোলা হবে কেন? এগুলো দেখভাল করার জন্য নিয়োজিতরা শুধু মাস ফুরালেই বেতন নেবেন আর এতগুলো মৃত্যুর জন্য নিজের কর্তব্যের দায় এড়াবেন- তাতো হয় না। মানুষের প্রতি মায়া থাকলে কর্তৃপক্ষের এসব হেঁয়ালীপনার দিকেও নজর থাকতো।

আগুন নেভাতে সবার দায় আছে। পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা এই দায়ভার অনেকাংশেই লাঘব করতে পারে। কিন্তু আমরা অনেকেই প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এই দায়ভার এড়িয়ে ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বাসার কাছে গ্যাস ও কেমিক্যাল মজুদ করছি  ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ-এর লাইন যুগ যুগ ধরে মেরামত করছি না। একই খুঁটিতে টিভি, ডিশ ও বিদ্দুতের তার সংযোজন করছি। ঘরের মধ্যে এসি লাগালেও ফায়ার ডিস্টিংগুইসার এলার্ম লাগাচ্ছি না।

এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোথাও বিল্ডিং কোড মানা হলেও কেউই ফায়ার কোড মানেনি। সাধারনত: ছয়তলা বিল্ডিং তৈরী করলেই সেখানে জীবনের নিরাপত্তার জন্য জরুরি ফায়ার কোড মানতে হবে। কিন্তু রাজধানীসহ সারা দেশে হাজার হাজার বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জরুরি ফায়ার কোড মানা হচ্ছে না। জনসমাগম বেশী এমন এলাকায় অগ্নিনির্বাপণের জন্য জরুরি সরঞ্জাম থাকা উচিত। জানা গেছে গুলশান কিচেন মার্কেটে অগ্নিনির্র্বাপণের জন্য প্রাইমারী কিটস্গুলোও ছিল না।

এমনিতেই ঢাকা শহরে চরম ট্রাফিক জ্যাম। ফলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দ্রুত দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। তার ওপর হঠাৎ জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ। যারা আগুনের দর্শক। এরা প্রায়শ:ই দেখা যায় রাস্তা দখল করে মজা করে মোবাইলে ভিডিও করছে। গুলশান কিচেন মার্কেটে আগুনে পোড়া আলু ও ডিম খেতে ব্যস্ত হয়েছিল কেউ কেউ! হায়রে বাঙালী! কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে যেন!

নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজরা ধরে নিয়ে যাবার সময় এক করুণ নাটক দেখা গিয়েছিল। একজন ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন- উপস্থিত মানুষগুলো একেকজন যদি দাঁড়িয়ে না থেকে যদি সবাই শত্রুদের প্রতি একটি করে ঢিল ছুঁড়তো তাহলে ইংরেজ সৈন্যরা পালাতে দিশা পেত না। কিন্তু সবাই ছিল বোবা দর্শক। বুদ্ধিহীন, অকর্ম্য, নির্বাক। ফলে বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার নবাবকে সেদিন বিনা বাধায় সিংহাসন হারাতে হয়েছিল। থাক্ সেসব কথা।

বাংলদেশ দুর্যোগের দেশ। তাই এখানকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বি.এন.সি.সি ও রোভার স্কাউটদেরকে জরুরি অগ্নিনির্বপনের প্রশিক্ষণ দেয়া হোক। জরুরিভিত্তিতে প্রতিটি হাইস্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা ও অগ্নিনির্বাপণের টিম তৈরী করা হোক। এরা বাড়ি বাড়ি বা বড় অফিস-আদালতে, মার্কেটে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে ছয়মাস অন্তর এলার্ম বাজিয়ে অগ্নিদূর্ঘটনা থেকে জীবন বাঁচানোর মহড়া পরিচালনা করে মানুষকে সতর্ক করতে পারে।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে- দেশে ফায়ার ফাইটার ৫০০ জনের নিচে। পুলিশের সংখ্যা ৩৫ হাজার। এই বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাহিনী থেকে কমপক্ষে পাঁচ হাজার জনকে জরুরি ভিত্তিতে অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণ দেয়া হোক। নৌ-ফায়ার ও উঁচু ভবনের আগুন নেভাতে আরো আধুনিক অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম কেনা হোক।

আগুনেমৃত্যু ঠেকাতে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক দল ও জরুরি অগ্নিপুলিশ বাহিনী গঠনের কোন বিকল্প নেই। অগ্নিনির্বাপক বাহিনির পরিদর্শকদেরকে নির্ভয়ে কাজ করতে দিতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশ- বিল্ডিং কোড না মানা ও ফায়ার কোড লঙ্ঘনকারী কিছু ভবনের মালিকগণ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শকদের কাউকে কাউকে তাদের সুষ্ঠু দায়িত্ব পালনে বাধা দিযেছে। এজন্য কাউকে পরবর্তীতে মামলার আসামী হিসেবে ফাঁসিয়ে অন্যত্র বদলী করে পর্যন্ত দেয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। এগুলো জাতির জন্য লজ্জাস্কর ও দুর্ভাগ্য স্বরুপ।

আমরা আর কোন প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখতে চাই না। এমন কষ্টদায়ক বা হৃদয়বিদারক মৃত্যুকে সবার মেনে নিতে কষ্ট হয়। আমাদের দেশে নৌ-ফায়ার ব্রিগেডের জনবল ও শক্তি এখনও প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। তাই ফায়ার ব্রিগেডের সামর্থ্য বাড়ানের পাশাপাশি আরো প্রয়োজন নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বেশী সংখ্যক ডুবুরী, আধুনিক সরঞ্জাম ও জরুরি নৌ-অগ্নিপুলিশ। এজন্য বিপর্যয় মোকাবেলা খাতে জরুরি ভিত্তিতে অর্থবরাদ্দ দিয়ে জীবনের নিরাপত্তা জোরদার করা হোক-মানুষকে নিরাপদ ভ্রমণে যাত্রাপথের নিরাপত্তা দেয়া হোক।

*লেখক সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সাবেক ডীন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর