ডেল্টা-ওমিক্রনের ‘যমজ হুমকি’ ও নববর্ষ উৎসব

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-30 05:47:40

প্রতিটি নববর্ষ আশাবাদের একটি নতুন আবহ নিয়ে সূচিত হয়। যদিও নববর্ষ বা অন্যান্য প্রতিটি দিনই সময়ের পরিমাপে ২৪ ঘণ্টার সমাহার এবং মানুষের জীবনে প্রতিটি দিনই, এমনকি প্রতিটি মুহূর্ত পর্যন্ত মহামূল্যবান। ইংরেজিতে একটি প্রবাদে বলা হয়েছে, 'Child, don't wait until it's too late. Lost time is lost forever.' অর্থাৎ, সময় হারিয়ে গেলে তা চিরতরেই হারিয়ে যায়। আর ফিরে আসে না। যেমন বলা হয়েছে, নদীর স্রোত আর সময় একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না।

ফলে নববর্ষ আসে পুরনো বছরের স্তূপে ভর করে। পুরনো সকল কাজকর্মের ফলাফলই বহন করে নতুন বছর। যে কারণে পুরাতন ও নতুন বছরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আত্মসমালোচনা, আত্মমূল্যায়ন ও আত্মসমীক্ষার সুযোগ ঘটে। নিছক উৎসব ও হুল্লোড়ে মেতে তা করা সম্ভব হয় না।

কিন্তু নববর্ষ বরণের উগ্র উৎসবের নামে সীমাহীন বেলেল্লাপনায় অনেক সময় আত্মসমালোচনা, আত্মমূল্যায়ন ও আত্মসমীক্ষার বারোটা বেজে যায় এবং নববর্ষ পালনের উৎসবটি নোংরামি, অশ্লীলতা ও আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়। বিশেষত, ইংরেজি নববর্ষ পালনের নামে থার্টিফাস্ট নাইটের সময় যে উদ্দামতা দেখা যায়, তা আইন, সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে বিপন্ন করে প্রায়শই।

বাংলাদেশের রাজধানী ও বড় শহরগুলোর অভিজাত এলাকার একশ্রেণির উৎশৃঙ্খল তরুণ-তরুণী থার্টিফার্স্ট নাইটের নামে উদ্দামতা, উন্মত্ততা ও উচ্ছলতার বল্গাহীন স্রোতে নিজেকে সঁপে দেয়। ঢাকার গুলশান, বনানী, উত্তরা, বারিধারায় সেসময় স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নিরীহ নাগরিকগণ আতঙ্কিত হন তখন। পরদিন সেসব এলাকার রাস্তা থেকে মদ, বিয়ারের খালি বোতল পরিস্কার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যান পরিচ্ছন্ন কর্মীগণ। কখনো কখনো নেশাপ্রবণ তারুণ্য সংঘর্ষ ও রক্তপাতের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা-দুর্ঘটনারও জন্ম দেয়।

এই ধরনের লাগামহীন উৎসবের পক্ষে বলার মতো কোনো যুক্তিই চলে না। ধর্ম, দর্শন, নীতি, নৈতিকতা, আইন ও মূল্যবোধের আলোকে এসব অনাচারের শামিল গর্হিত কাজ। ফলে নববর্ষ বা বর্ষবরণের নামে কোনো ধরনের সীমালঙ্ঘন ও অশ্লীলতাকে ধর্ম-দর্শন নির্বিশেষে শুভবোধসম্পন্ন সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারেন না।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠানের নামে ঢাকা ও অন্যত্র প্রতি বছরই যে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়, তা সত্যিই লজ্জার, বেদনার ও ঘৃণার বিষয় । এসব অনুষ্ঠানে নতুন বছরের সু-কামনা, বাসনা আর প্রত্যাশার মূলে কুঠারাঘাত করা হয় এবং আশার বদলে হতাশা ও অপচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যা নতুন বছরের শুচি ও শুভ্রতায় কলঙ্ক লেপনের নামান্তর।

নববর্ষ বা বর্ষবরণের নামে কোনো ধরনের সীমালঙ্ঘন ও অশ্লীলতাকে কোনো ধর্মই সমর্থন করে নি। কোনো দেশের আইন অবাধে উৎসবের নামে বন্যতাকে সমর্থন জানায় নি। বিশ্বের কোনো সমাজের সংস্কৃতিই উৎসবের নামে অনাচারকে বৈধতা দেয় না। তথাপি, কোনো কোনো দেশে, বিশেষত বাংলাদেশে ইংরেজি বছরকে বিদায় ও বরণের নামে যে মাত্রাতিরিক্তভাবে মাতামাতি করা হয়, তা মোটেও কাম্য নয়।

এমনকি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে কোনো উন্মুক্ত স্থানে নাচ, গান, কনসার্টসহ কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে না- বলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও অনেকে তা মান্য করেন না। যদিও করোনার মহাপ্লাবন ধেয়ে আসার সময় মাস্ক, স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব প্রতিপালন করা আইনগত ও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অবশ্যপালনীয় বিষয়। বিশেষত করোনার নতুন ও আগ্রাসী ভ্যারিয়্যান্ট ওমিক্রনের ধাবমান উদ্বেগের মধ্যে শুধু বাংলাদেশই নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞগণ সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ফলে ইংরেজি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণে ভিড় এবং উৎসব থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ওমিক্রন কিন্তু কোভিডের আগের রূপগুলোর থেকে অনেক বেশি সংক্রামক। অল্প সময়ের মধ্যেই একাধিক মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রয়েছে ওমিক্রনের।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, কড়াকড়ি এবং বিধিনিষেধের মধ্যেই রাজধানীর তারকা হোটেলগুলোতে ইংরেজি নতুন বছর বা থার্টিফার্স্ট উদ্‌যাপন করতে নেয়া হয়েছে নানা প্রস্তুতি। থাকছে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেয়া হয়েছে হোটেলের হল, বলরুম। হোটেলগুলোতে সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ডিজে ড্যান্স পার্টি, ককটেল পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিজাত ক্লাবগুলোতে পার্টির জন্য ভাড়া করা হবে ডিজে গার্লদের। হোটেলগুলোতে ডিজে পার্টি ছাড়াও নানা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া এসব আয়োজন চলবে ভোররাত পর্যন্ত। হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের অনুষ্ঠান অর্গানাইজার মিডিয়াকে বলেছেন, ‘থার্টিফার্স্ট উপলক্ষে থাকছে ক্যাফে বাজারের স্পেশাল ডিনার, স্পেশাল নাইট মিউজিক উইথ বারবিকিউ ডিনার।’ নানা আয়োজন করা হয়েছে ওয়েস্টিন হোটেলে, রেডিসন ব্লু ঢাকায়, হোটেল লা মেরিডিয়ানে।

এই যখন বাংলাদেশের অবস্থা, তখন কিন্তু বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি অতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশে একদিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা নতুন রেকর্ড করেছে। করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এ যাবতকালের মধ্যে বিশ্বে একদিনে সর্বোচ্চ কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। গড়ে দিনে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ৯ লাখ মানুষ।

ভারতে একদিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। রাজ্য সরকারগুলোকে প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারির ক্ষমতা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এরই মধ্যে মুম্বইয়ে আগামী ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে করোনাভাইরাস সংক্রমণকে ‘স্টেট অব কনসার্ন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সংক্রমণ রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ফ্রান্স, ডেনমার্ক, পর্তুগাল, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেডরোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস সতর্ক করেছেন বিশ্ববাসীকে। তিনি বলেছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণে এক বিপজ্জনক সুনামির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব।

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ড গড়ার মুখে বিদায়ী বছর ২০২১ সালের শেষ দিকে ফ্রান্সে এ যাবৎকালের মধ্যে একদিনে কমপক্ষে দুই লাখ আট হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। গত এক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে দিনে গড়ে রেকর্ড দুই লাখ ৬৫ হাজার ৪২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) পোল্যান্ডে করোনায় মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯৪ জন। করোনার চতুর্থ বা সর্বশেষ ঢেউয়ের এই সময়ে এটাই সেখানে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। উল্লেখ্য, এসব মানুষের চার ভাগের তিন ভাগের বেশি করোনাভাইরাসের টিকা নেননি।

আক্রান্তের মতো তীব্র গতিবেগে বিশ্বের বহু দেশে অতিদ্রুততায় ছড়িয়ে পড়েছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। ডেল্টার চেয়ে এর সংক্রমণ সক্ষমতা অনেক বেশি। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে তা কম ভয়াবহতা সৃষ্টি করে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন করে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধিতে এই ভ্যারিয়েন্টের ভূমিকা বেশি। ওমিক্রন সংক্রমণকে ‘করোনার ঢেউ’-এর বদলে ‘জোয়ারের ঢেউ’ নামে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞগণ। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেল্টা এবং ওমিক্রনকে ‘যমজ হুমকি’ হিসেবে সতর্ক করেছে। কারণ, প্রতিদিন মোট যে পরিমাণ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন, তার প্রায় সবই এই দুটি ভ্যারিয়েন্টে।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোর মতে, বর্তমানে প্রতিদিন বিশ্বে নতুন করে প্রায় ৯ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, ফ্রান্সে প্রতি সেকেন্ডে দু’জন করে মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ওমিক্রনে এই সুতীব গতি সুনামিকেও হার মানায়। ফলে বাংলাদেশে বর্ষ বিদায় আর নববর্ষ উৎসব লাগামছাড়া হলে সংক্রমণের হার যে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। ব্যক্তি থেকে সামাজিক বা গোষ্ঠী সংক্রমণের মতো বিপজ্জক পরিস্থিতিও তৈরি হবে তখন, যা প্রতিহত করা স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ ও অবকাঠামোগত দিক থেকে সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অতএব, বিপদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আগেই সতর্কতা অপরিহার্য। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর