ডিজিটাল বাংলাদেশ - 4G/5G মোবাইল প্রযুক্তি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন | 2023-09-01 09:05:49

ইতিহাসে প্রথমবারের মত জাতিসংঘের কাছে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই অর্জন আমাদের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে সুন্দর অর্জন। বর্তমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছার ফলেই আজ জাতি নতুন এক গৌরবোজ্জ্বল পথে দাঁড়িয়ে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য পূরণে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে দেশের সকল স্তরে। তবে এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদেরকে বেশ কিছু বাঁধা অতিক্রম করতে হবে।

দুর্বল ও ব্যয়বহুল নেটওয়ার্ক

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মাঝে অন্যতম হলো দেশের দুর্বল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এই দিকটায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নেটওয়ার্ক ডরেডিনেস ইনডেক্স (NRI) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেটওয়ার্কের উন্নতির উপর ভিত্তি করে প্রতিবছর একটি র্যা ঙ্কিং তৈরি করে। ২০১৭সালে বাংলাদেশ NRI র্যাঙ্কিংয়ে ১৪৮টি দেশের মাঝে ১১২তম স্থানে রয়েছে।এই স্কেলে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের স্কোর ৩.৩। যেখানে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৬৩ (স্কোর ৪.২), ভুটানের অবস্থান ৮৭ (স্কোর ৩.৮), ভারতের অবস্থান ৯১ (স্কোর ৩.৮) এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১১০ (স্কোর ৩.৪)।

শক্তিশালী নেটওয়ার্কের অভাবে দেশের সকল প্রান্তে থ্রিজি প্রযুক্তি ঠিকমত পৌঁছায়নি। যার ফলে থ্রিজি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা আমরা এখনো পাচ্ছি না। ফোরজি প্রযুক্তিকেও একই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে।

দক্ষিন ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক তুলনামুলকভাবে দুর্বল হলেও ইন্টারনেট সংযোগ আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ের তুলনায় বেশ ব্যয়বহুল। United Nations ESCAP এর জন্য প্রস্তুত করা এক রিপোর্টে বাংলাদেশের IP Transit Price উল্লেখ করা হয়েছে ব্যয়বহুল বা Expensive হিসাবে। বিভিন্ন কোম্পানির মাঝে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলেও ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশন খরচ মানুষের আয়ের তুলনায় অনেক ব্যয়বহুল (Very Expensive) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ভুটান ও ভারতের ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশন ও সেটআপ খরচ যুক্তিসঙ্গত (Reasonable) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে শ্রীলংকা। শ্রীলংকার ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি Sufficient হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, যদিও সেখানে টেলিকম মার্কেটে প্রতিযোগিতা তুলনামুলকভাবে কম। শ্রীলংকার ইন্টারনেট সাবস্ক্রিপশন ও সেটআপ খরচ মূল্যায়ন করা হয়েছে Affordable হিসাবে।

4G এবং LTE: নতুন যুগে পদার্পণ

3G সেবায় গ্রাহকরা কতটুকু সন্তুষ্ট তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মূলত দুর্বল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা আর দেশের সকল প্রান্ত থেকে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার অভাবের ফলে 3G সেবায় আমাদের দেশের জনগণ যথেষ্ট লাভবান হতে পারেননি। বাংলাদেশ নতুন 4G প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করলেও দেশের সকল প্রান্তে শক্তিশালী ও দ্রুতগতির সেবা নিশ্চিত করার জন্য নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।

ইন্টারনেট প্রযুক্তি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকার ফলে 3G বা 4G এর মাঝে মূল পার্থক্য কি তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। 4G প্রযুক্তিতে শুধুমাত্র ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি হয় না, সেই সাথে কাঠামোগত অনেক পরিবর্তনও আসে। G দ্বারা Generation বা প্রজন্ম বোঝানো হয়। নতুন প্রজন্ম মানে উন্নত ইন্টারনেট গতি এবং নতুন সেবা। 1G এবং 2G দ্বারা যথাক্রমে অ্যানালগ ও ডিজিটাল মোবাইল প্রযুক্তি বোঝানো হয়। তবে 3G থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে আলাদা করা হয় ডাটা ট্রান্সফার করার রেট ও পদ্ধতি দ্বারা। সাধারণত পরবর্তী প্রজন্মে ডাটা ট্রান্সফার গতি বেশি থাকে। এই গতি বৃদ্ধির জন্য ডাটা ট্রান্সফার করার প্রোটোকল বা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা হয়।

International Telecommunication Union - Radiocommunication Sector (ITU-R) এর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, মোবাইল ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট সংযোগ 4Gহিসাবে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পিক স্পিড ন্যুনতম ১০০ মেগাবিট পার সেকেন্ড হওয়া উচিত, আর স্থির (stationary) ডিভাইসের জন্য তা ন্যুনতম ১ গিগাবিট পার সেকেন্ড হওয়া উচিত।২০০৮ সালে এই স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছিল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, কারন তখন সকলেই অনুধাবন করতে পেরেছিল যে অদূর ভবিষ্যতেই এমন উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া সম্ভব হবে।

সেই সময়ে এত উচ্চ গতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না, যার ফলে রেগুলেটিং বডি সিদ্ধান্ত নেয় যে LTE প্রযুক্তিকে যথেষ্ট উন্নত করা সম্ভব হলে তাকে 4G প্রযুক্তি বলে গ্রহন করা হবে। যার ফলে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান LTE (Long Term Evolution) প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে শুরু করে, কারন LTE প্রযুক্তিকে দ্রুত উন্নত করে তাকে 4G এর পর্যায়ে নিয়ে আসাটাই তখন সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উপায় ছিল। বিভিন্ন নেটওয়ার্ক কোম্পানি তাদের কানেকশনকে 4G LTE উপাধি দিয়ে প্রচার করতে থাকে যে তাঁরা ইন্টারনেট সেবার চতুর্থ প্রজন্মে পৌঁছে গেছেন, যদিও তাদের ইন্টারনেট গতি ITU-R এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যথেষ্ট ছিল না। বর্তমানে LTE প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত হয়েছে, LTE-A (Long Term Evolution Advanced) প্রযুক্তির আপলোড ও ডাউনলোড স্পিড 4G এর স্ট্যান্ডার্ড এর প্রায় কাছাকাছি। 4G প্রযুক্তির অন্যতম পরিবর্তন হলো সার্কিট সুইচিং পদ্ধতি বিলুপ্ত করে ইন্টারনেট প্রোটোকল (IP) ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। 3G প্রযুক্তিতে Spread Spectrum এর মত রেডিও টেকনোলজি ব্যবহৃত হত, যা 4G তে ব্যবহার হয় না। চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবায় তার বদলেOFDMA multi-carrier পদ্ধতিতে ট্রান্সমিশন সম্পন্ন হয়।

5G: ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা

২০২০ সালের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলো 5G প্রযুক্তিতে প্রবেশ করতে চলেছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদেরকেও 5G প্রযুক্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

5G দ্বারা আগামী প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তি বোঝানো হয় যা বর্তমান 4G প্রযুক্তির চেয়েও উন্নত।আগের সকল জেনারেশন বা প্রজন্মের মতই 5G এর মূল লক্ষ্য হলো মোবাইল কমিউনিকেশন আরো দ্রুতগতির করা এবং অনলাইনে থাকা ডিভাইসের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে নেটওয়ার্ক আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করা।

এক দশক আগেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে মোবাইল ফোনের চাহিদা ছিল শুধুমাত্র কল দেওয়া, মেসেজ পাঠানো আর ওয়েব ব্রাউজিংয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কাছে রয়েছে একাধিক স্মার্ট ডিভাইস যাদের প্রত্যেকটির ব্যান্ডউইথ ডিমান্ড অনেক বেশি। এইচডি কোয়ালিটিতে স্ট্রিমিং করার ক্ষমতাসম্পন্ন স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ, চব্বিশ ঘন্টা সচল সিকিউরিটি ক্যামেরা, ইন্টারনেট সংযুক্ত গাড়ি, স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করার মত স্মার্ট মেশিন এমনকি ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির হার্ডওয়্যার থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে হলে দরকার অত্যন্ত দ্রুতগতির এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ যা বর্তমান প্রযুক্তি আমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে দিতে সক্ষম হচ্ছে না।

অনলাইনে ইন্টারঅ্যাকটিভ গেম বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এই ধরণের গেমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার গেমার একইসাথে খেলার জন্য সংযুক্ত হতে চায়। বিপুল পরিমাণ ডিভাইস থেকে প্রতি সেকেন্ডে অসংখ্য রিকোয়েস্ট পায় গেমিং সার্ভার, এবং প্রতিটি গেইমার চায় তার রিকোয়েস্ট যেন দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়। গোটা ইন্টারনেটের বর্তমান অবস্থাও অনেকটা এরকম। ইন্টারনেটে এখন বিলিয়নের অধিক ডিভাইস সংযুক্ত হচ্ছে। যার ফলে গোটা ইন্টারনেটের কাঠামো পুনরায় এমনভাবে সজ্জিত করতে হবে যেন ইন্টারনেটে সংযুক্ত এই বিপুল সংখ্যক ডিভাইসগুলো শুধু দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবাই না পায়, বরং একই সময়ে অসংখ্য ডিভাইসের কানেকশন বজায় রাখে অনেক বেশি কভারেজ প্রদান করতেপারে ।সেই লক্ষ্যেই 5G বা পরবর্তী প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব।

বিভিন্ন G এর মাঝে মূল পার্থক্য কি তা অনেকেই বুঝতে পারেন না।5G আসলে 4G এর পরবর্তী প্রজন্ম যা তার আগের প্রজন্মগুলোর মতই পূর্ববর্তী প্রজন্মকে প্রতিস্থাপিত করবে। 1G থেকে 4G পর্যন্ত আমরা কোন ধরণের সেবা পেয়েছি তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:

১. 1G মূলত অ্যানালগ সেলুলার ফোন সিস্টেমকে বোঝায়। একেবারে প্রথমদিকের এই ফোনগুলোতে একে অপরের সাথে কথা বলা ছাড়া তেমন কোন সুবিধা ছিল না।

২. 2G বা দ্বিতীয় প্রজন্মে উল্লেখযোগ্য যে পরিবর্তন আসে তা হলো ডিজিটালাইজেশন। 2G দ্বারা ডিজিটাল সেলুলার ফোন সিস্টেম বোঝায়। 2G ব্যবহারকারীরা একে অপরকে এসএমএস ও এমএমএস পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন, সেই সাথে ইন্টারনেট ব্রাউজিং শুরু হয়েছে এই প্রজন্ম থেকে। 2G প্রযুক্তি থেকে কল ও টেক্স এনক্রিপশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। 2G এর জেনারেল প্যাকেট রেডিও সার্ভিস (GPRS) এর সর্বোচ্চ স্পিড ৫০ কিলোবিট পার সেকেন্ড (50 Kbps) এবং এনহ্যানচড ডাটা রেটস ফর জিএসএম ইভল্যুশন (EDGE) এর সর্বোচ্চ স্পিড ১ মেগাবিট পার সেকেন্ড (1 Mbps) ।

৩.2G ও 3G এর মাঝে আসে 2.5G এবং 2.75G যা মূলত 2G ও 3G এর মাঝে ব্রিজ হিসাবে কাজ করেছে। 2.5G তে নতুন প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যা পূর্বে ব্যবহৃত প্রযুক্তির চেয়ে অধিক সক্ষম হিসাবে প্রমানিত হয়েছে। 2.75G তে নেটওয়ার্কের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপর খুব দ্রুতই চলে আসে 3G প্রযুক্তি।

৪. ১৯৯৮ সালে 3G প্রযুক্তির উন্মোচন হয়। মোবাইল প্রযুক্তির মাঝে এটি তৃতীয় প্রজন্ম হিসাবে পরিচিত। 3G প্রযুক্তির ফলে ব্যবহারকারীরা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ উপভোগ করতে পারেন, যার মাধ্যমে ভিডিও কলিং এবং দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেট ব্রাউজিং সম্ভব। 2G এর মতই 3G প্রযুক্তিও 3.5G এবং 3.75G তে উন্নীত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা পরবর্তী প্রজন্ম 4G আসার পথ সুগম করেছে। স্থির অবস্থানে থাকা ডিভাইসে3G প্রযুক্তির সর্বোচ্চ স্পিড প্রায় 2 Mbps আর চলন্ত গাড়িতে থাকা ডিভাইসে সর্বোচ্চ স্পিড প্রায় 384 Kbps।

৫.4G বা মোবাইল প্রযুক্তির চতুর্থ প্রজন্ম ২০০৮ সালে বাজারে আসে। 4G তে এইচডি মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্সিং, 3D টিভিসহ এমন বেশ কিছু সেবা পাওয়া সম্ভব যেগুলোতে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রয়োজন। যেসকল 4Gপ্রযুক্তিমার্কেটেরয়েছেতাদেরমাঝেWiMAX এবং LTEঅন্যতম। 4G LTE প্রযুক্তির সর্বোচ্চ স্পিড 5 Mbps হতে 12 Mbps পর্যন্ত হতে পারে।

এই সকল প্রযুক্তির সাথে 5G এর পার্থক্য কোথায়? 5Gপ্রযুক্তিতেমূলতঅত্যন্ত দ্রুতগতির ইন্টারনেট গতির পাশাপাশি ডাটা লোড নেওয়ার সময় (Delay) কমানোর উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বিপুল সংখ্যক ইন্টারকানেক্টেড ডিভাইসের জন্য Delayকমানোঅত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ।

5G আমাদের যোগাযোগক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারবে। 5G এর কিছু উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

১. শিক্ষা ক্ষেত্র:5G এর উচ্চগতি এবং Reliability এর ফলে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। ২০১৩ সালে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতি ৫৩ জন শিক্ষার্থীদের জন্য ১ জন শিক্ষক বরাদ্দ রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলের দিকে শিক্ষকের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী যথাযথ শিক্ষা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আর ইচ্ছা বেশি তারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকায় চলে আসছে। কিন্তু এর ফলে প্রতিনিয়ত ঢাকায় চাপ বৃদ্ধি হচ্ছে। দেশের সর্বত্র শিক্ষার মতো সেবা পৌঁছে দিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগ। দেশের সকল প্রান্তে শক্তিশালী ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অভাবে থেমে থাকবে না। শহরাঞ্চল থেকেই শিক্ষকরা মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্লাস নিতে সক্ষম হবেন। 5G প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা হলো ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির ব্যাপক প্রয়োগ। অগমেন্টেড রিয়্যালিটি ডিভাইস ও ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হেডসেটের জন্য প্রয়োজন পড়ে অনেক বেশি ব্যান্ডউইডথ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির ব্যবহার করে শিক্ষা অর্জন অনেক বেশি আনন্দময় এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ করে তোলা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা তাদের চোখের সামনেই দেখতে পারবে বিজ্ঞান, ইতিহাস বা ব্যবসার নানা বিষয় যার ফলে তারা দ্রুত শিখতে সক্ষম হবে।

২. চিকিৎসা ক্ষেত্র: ঘনবসতির ফলে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার নেই। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি ১২,৬৯০ জন মানুষের জন্য একটি ডাক্তার রয়েছে, যেখানে WHO এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রতি ১৪০০ মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার থাকা উচিত। উচ্চগতির ইন্টারনেট দেশের দূরদূরান্তে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলে শহরের ডাক্তাররা ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্রামের রোগী দেখেত এবং পরামর্শ দিতে পারবেন। এছাড়া ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা আধুনিক উপায়ে মেডিক্যাল শিক্ষা অর্জন করতে পারবেন।

৩. ড্রাইভারবিহীন গাড়ি: উন্নত দেশগুলোতে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে। চালকবিহীন গাড়ির অন্যতম বড় ঝুঁকি হলো হঠাৎ করে কোন বিপত্তি আসলে সেটা সামলানোর ভাল উপায় বের করা। চালকবিহীন গাড়িতে যেহেতু গাড়িকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাই গাড়ির দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজন উচ্চগতির ও রিলায়েবল ইন্টারনেট সেবা।

৪. ইন্টারনেট অব থিংস ও কানেক্টেড ডিভাইস: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য বস্তু বা ডিভাইস ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। কৃষকেরা যেমন ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহার করে ক্ষেত ও খামারের আদ্রতা, ফসলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে পারেন, তেমনই গাড়ি চালকরা জানতে পারেন যে রাস্তায় জ্যাম আছে কিনা। এই ডিভাইসগুলোর প্রয়োজন হয় রিয়াল-টাইম ডাটা অ্যানালিটিক্স, যা কিনা উচ্চগতির ইন্টারনেট ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়।

৫. ব্যক্তিগত চাহিদা ও বিনোদন: সময়ের সাথে সাথে ডাটার প্রতি মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই চাহিদা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। ভিডিও কনফারেন্সিং, ফাইল ডাউনলোড, অনলাইনে মুভি স্ট্রিমিং, এইচডি ও 4K কোয়ালিটির মিডিয়া শেয়ার করাসহ বিভিন্ন কারনে মানুষ এখন আগের চেয়েও উচ্চগতির ইন্টারনেট চায়।

5G প্রযুক্তির স্পিড কত হবে? 5Gপ্রযুক্তির জন্য প্রতিটি মোবাইল স্টেশনে ন্যুনতম যে পিক ডাটা রেট থাকা প্রয়োজন তা দেওয়া হলো:ডাউনলোড স্পিড: 20 Gbps এবংআপলোড স্পিড: 10 Gbps. তবে এই স্পিড বেজ স্টেশনের সাথে সংযুক্ত সকল ব্যবহারকারীর কাছে ভাগ করে দেওয়া হবে, যার ফলে প্রতিটি ব্যবহারকারী যে স্পিড উপভোগ করতে পারবেন তা হলো: ডাউনলোড স্পিড:100Mbps এবং আপলোডস্পিড: 50Mbps. যার ফলে একজন ব্যবহারকারী 3GB এর কোন ফাইল মাত্র ৪ মিনিটেই ডাউনলোড করতে সক্ষম হবেন।5G প্রযুক্তি প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ মিলিয়ন কানেক্টেড ডিভাইসকে সাপোর্ট দিতে পারবে। যার ফলে ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকাতেও উচ্চগতির নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া সম্ভব। 5G প্রযুক্তির ল্যাটেন্সি (Latency) মাত্র ৪ মিলিসেকেন্ড। ল্যাটেন্সি দ্বারা বোঝানো হয় সেল টাওয়ার থেকে ডাটা ব্যবহারকারীর মোবাইলে পৌছানোর জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন হয়।

 প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

এ সম্পর্কিত আরও খবর