জীবনটাও একটা প্রজেক্টেরই মতো

, যুক্তিতর্ক

হাসিন মাহবুব চেরী | 2023-08-30 08:59:53

ইউরোপের ওয়ার্ক কালচার এশিয়ার চেয়ে আলাদা। আবার এশিয়ার মধ্যে চীন, জাপান, কোরিয়ার কাজের গতি ও ধরন ভিন্ন। তবে, সামগ্রিকভাবে ইউরোপের কাজের প্যাটার্ন ও সংস্কৃতি একই রকম, যাতে গবেষণাগার আর ব্যবহারিক-ফলিত প্রয়োগের চমৎকার সমন্বয়ের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ, চর্চা ও উন্নয়নমুখী বিভিন্ন তৎপরতা অব্যাহত থাকে।

তো কিছুদিন আগে কর্পোরেট সায়েন্টিস্টদের একটা ওয়ার্কশপে গিয়েছিলাম। কর্পোরেট সায়েন্টিস্টদের খুব tough deadline এ কাজ করতে হয়। তাই ওয়ার্কশপের বিষয়বস্তু ছিলো, কিভাবে একজন সায়েন্টিস্ট এই নির্দিষ্ট ডেডলাইনের মধ্যে সফল ভাবে তার প্রজেক্টটি সম্পাদন করবে।

সেই ওয়ার্কশপে শেখানো হলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার মূল মর্ম হলো এই যে, জীবনের যেকোনো কাজ সফল ভাবে সম্পাদন করার জন্যে ৪ টি মৌলিক নীতি মেনে চলা উচিৎ। সেগুলো হলো :

১. Be the Leader;

২. Be Flexible 

৩. Be Caring;

৪. Collaborate.

এখন যদি গভীরভাবে ভাবি, তাহলে বুঝতে পারবো যে, আমাদের পেশা বা কর্মের মতোই জীবনটাও কিন্তু একটা প্রজেক্টেরই মতো। আমরা পৃথিবীতে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে আসি। এই সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আমাদের জন্যে বরাদ্দ সময়কে কাজে লাগিয়ে যদি কেউ একটা successful জীবন পেতে চায় তাহলে আসলে এই চারটি মৌলিক নিয়ম পালন করা অত্যাবশ্যক!

একটু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। চারটি মৌলিক নীতির আলোকে জীবনকে দেখলে স্পষ্ট হবে যে, জীবনটাও কিন্তু একটা প্রজেক্টেরই মতোই। আর সেখানে এমনি এমনি সাফল্য আসবে না। কিছু নীতি ও পদ্ধতি পালন করেই সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করতে হবে। যেমন:

১.Be the Leader: একজন মানুষকে নিজের জীবনের নেতৃত্ব তাকেই দিতে হবে। জীবন থেকে সে কি চায়, এটা আসলে নিজেকেই নির্ধারণ করতে হবে। অন্যেরা কি বলছে সেটা ভেবে সময় নষ্ট না করে বরং সেই স্বপ্নগুলো পূরণের জন্যে তার নিজেকেই নেতার মতো উদ্যোগী হয়ে অগ্রসর হতে হবে।এই স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ হলো একটা পরিকল্পনা করা, দ্বিতীয় ধাপ হলো সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তার জীবনে যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, সেসব পরিবর্তনকে পজিটিভ মানসিকতা নিয়ে গ্রহণ করে জীবনকে উপভোগ করার মানসিকতা তৈরী করা। এজন্যেই George Bernard Shaw বলেছেন - ‘’Progress is impossible without change and those who cannot change their mind, cannot change anything.”

২. Be Flexible: জীবনে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কিছুটা flexible হয়ে অনেক কিছু গ্রহণ করার মানসিকতা থাকা জরুরি। কেননা  জীবনে যখন বড় কোনো সুযোগ আসবে, অতিরিক্ত নেগেটিভ চিন্তা না করে সেই সুযোগ গ্রহণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ! এটা মনে রাখা জরুরি যে সুযোগ কিন্তু বার বার আসে না এবং  যারা কোনো রিস্ক নেয়না তারা জীবনে কিছু অর্জন করতেও পারে  না। আর সময়ের সিদ্ধান্ত সময়েই নিতে না পারলে সেই সুযোগ আজীবন কারো জন্যে অপেক্ষা করে না ! আরেকটা পয়েন্ট হলো, আমাদের জীবন কিন্তু গোলাপের বিছানা নয়, সুতরাং নেগেটিভিটি জীবনেরই অংশ। তবে জীবনে নেগেটিভ কিছু হলে সেটা আঁকড়ে বাকি জীবনটাকে থামিয়ে না দিয়ে বরং সেটা মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্দ্বিমানের কাজ।  কেননা আমাদের হাতে সময় খুব অল্প আর আমরা কেউ এই পৃথিবীতে অনন্তকালের জন্যে আসিনি। সুতরাং নেগেটিভ বিষয় নিয়ে অমূল্য সময় যত কম নষ্ট করা  যায় ততই ভালো।  মনে রাখবেন: Time and tide waits for none!

৩. Be Caring: জীবনে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে caring হওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। কেননা caring creates connections! আর connection তৈরির মাধ্যমেই কেবল আপনি নিজের আশেপাশে আপনার প্রয়োজনে আরেকজনকে কাছে পাবেন। এক্ষেত্রে empathic হওয়া বা অন্যের অনুভূতি বিবেচনায় নেয়াটাও কিন্তু সম্পর্ক তৈরির অন্যতম ভিত্তি। যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই  অপর মানুষটির মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা এবং সেই মতামতকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করা জরুরি। তাছাড়া মানুষের সাথে কেবল অনেক কাছে থেকে মিশলেই বোঝা যায়, কে আপন আর কে পর ! আর এই শিক্ষাগুলোই ভবিষ্যতে জীবনের কঠিন সময়গুলোকে মোকাবেলার জন্যে মানুষকে তৈরি করে দেয়। তবে কাকে care করছেন সেটাও খেয়াল রাখা উচিৎ, কেননা উলুবনে মুক্তা ছড়ালে সেটার মূল্য তো কেউ বুঝবে না !

৪. Collaborate: মানুষ জন্মগত ভাবে সামাজিক জীব। তাই জীবনে বড় কোনো সাফল্য পেতে হলে অন্য মানুষদের সাথে collaboration এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখা জরুরি যে, আপনি কার সাথে collaborate করছেন বা সহজ ভাষায়, বন্ধু হিসেবে কাকে বেছে  নিচ্ছেন! কেননা একজন জ্ঞানী, সৎ ও ভালো মনের বন্ধু যেমন আপনাকে ভালো কিছুর জন্যে অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি একজন খারাপ মনের অলস প্রকৃতির অসৎ বন্ধু আপনাকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে আনতে কসুর করবে না ! সুতরাং আপনি বন্ধু হিসেবে কাদের সাথে মিশছেন সেটার সরাসরি  প্রভাব পড়বে আপনার সামগ্রিল জীবনে।  মনে রাখবেন, মানুষ তার বন্ধু ও সহযোগিদের দ্বারা পরিমাপ হয়। কে কার সঙ্গে চলে, উঠাবসা করে, সামাজিকভাবে এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে ব্যক্তিগত জীবনেও বন্ধু ও সহচরদের সু বা কুপ্রভাব অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।

আসলে কে জীবনে কতটা সফল, সেটার পরিমাপক হলো সেই মানুষটা মানসিক ভাবে কতটা সুখী, তৃপ্ত ও আনন্দময়। সুতরাং আপনার জীবনের সুখের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজ সংসারের অন্য কাউকে দোষারোপ করে কোনোই লাভ নেই কারণ জীবনটা আপনার! আর দিনশেষে আপনার কষ্টের ভাগ কিন্তু কেউই নিতে আসবে না! সুতরাং, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার চেষ্টার মাধ্যমে নিজে ভালো থাকুন, ভালো রাখুন। আপনার ভালোবাসার মানুষগুলোকেও ভালো রাখুন! এবং এসবের মধ্যে প্রাপ্ত সাফল্যের আলোকে তৃপ্ত ও আনন্দময় থাকুন।

হাসিন মাহবুব চেরী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাইক্রোবায়োলজিস্ট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর