মানুষ রতন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, ও বন্ধু আমার...

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

সৈয়দ রানা মুস্তফী | 2023-08-31 00:14:53

বার/তের বছর আগের কথা। আদমজী ইপিজেডে বেপজা থেকে প্রায় ১৭ বিঘা জমি লীজ নিয়ে মাদারল্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাপারেলস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে বাংলাদেশ-ইউনাইটেড অ্যারাব এমিরেটস যৌথ বিনিয়োগের কম্পোজিট নীট প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছি। রাত-দিন পরিশ্রম করছি প্রোজেক্ট গোছাতে। সমাজ-সংসার ধ্যান-জ্ঞান সবই তখন এই প্রকল্প। সদ্য মাস্টার্স করা উজ্জ্বল তরুণ মাকসুদকে নিয়োগ দিয়েছি জেনারেল ম্যানেজার পদে। প্রায় অসম্ভব ওয়ার্ক লোড বহনের সেসব দিন-সপ্তাহ-মাসগুলোতে মাকসুদ আমার ছায়াসঙ্গী ছিলো। মাকসুদের সততা, বিনয়, আনুগত্য ও কর্তব্যপরায়ণতায় তখন থেকেই আমি ওকে আপন ছোট ভাইয়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসি, বলা যায় পুত্রজ্ঞান করি।

ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ওয়ার্কার্স শেড, বাউন্ডারী ওয়াল, ডিপ টিউবওয়েল, সার্ভিস এরিয়া, অভ্যন্তরীণ সড়ক, সরকারী স্ট্যাম্পের বিপুল খরচ, জমির রেন্টাল ও লীজমানি মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা বলতে গেলে চোখের পলকে কীভাবে যে খরচ হয়ে গেলো- তা বলতেই পারি না! এর পর এলো ওয়ান ইলেভেন পূর্ববর্তী সেই মারাত্মক সহিংস 'রাজনৈতিক আন্দোলন'। দুবাই ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, শেখ যায়েদ ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট এবং ইউএই ইনিশিয়েটিভ রাস্তায় পিটিয়ে মানুষ মারা দেখে ভয়ে আতঙ্কে নিজেদের প্রত্যাহার করলো আমার প্রকল্প থেকে। রাগ, ক্ষোভ, নগদ অর্থনাশের বেদনা ও নিষ্ফল পরিশ্রমের হতাশায় আমি কিছুটা মুষড়ে পড়লাম বলা যায়। অনেকটা অজান্তেই মাকসুদও যেন চোখের আড়ালে চলে গেলো। ওর মধ্যেও হয়তো বেদনা ছিল যে, ওর হাত দিয়েই দিয়ে লক্ষ-কোটি টাকা খরচ হলো ঠিকই কিন্ত তার কোনো সাফল্য এলো না...।

হঠাৎই ফেসবুকের সেতু মাকসুদ সিকদারকে আবার কাছে নিয়ে এলো। এক গভীর রাতে ইনবক্সে কুণ্ঠিত ভাষায় মাকসুদ লিখলো- 'স্যার! ভীষণ সমস্যায় আছি, আপনার সঙ্গে দেখা করে কথা বলা খুব জরুরি।’ মাঝখানে প্রায় ১০ বছরের বিচ্ছিন্নতায় তরুণ মাকসুদের যে এতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে তা আমার ধারণায়ও ছিল না। কুচকুচে কালো চুল পেকে গেছে, ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছে শরীরে, রোগে শোকে কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে সেদিনের দ্যুতিময় মাকসুদ। শুধু চোখে মুখে দেখলাম জ্বলে উঠবার প্রত্যয় এখনও নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে মাকসুদের।

জানতে চাইলাম মাকসুদের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে। ওর মুখ থেকে জেনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। দুঃখে, কষ্টে ও ক্ষোভে আমার হৃদয় ভেঙ্গে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, যা করা লাগে করবো, তবু মাকসুদকে উদ্ধার করবোই- ইনশাআল্লাহ। যে ব্যাংকগুলো এদেশের শিল্পায়নের গোড়পত্তন করেছে, উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে, সেই ব্যাংকগুলোর অগ্রবর্তী প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের কারণে রীতিমত মরতে বসেছে মাকসুদ। জানলাম গণমানুষের ব্যাংকার, সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন সিইও এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রদীপ দত্ত দার ঐকান্তিক সহযোগিতায় নরসিংদীর বেলাবোতে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিয়ারসন্স এগ্রো নামে একটি অটোমেটিক ফিড মিল শিল্প স্থাপন করেছে আমাদের মাকসুদ। যথাসময়ে সে শিল্পটি স্থাপনার কাজ শেষও করেছে সে, কিন্ত যে কোনো শিল্পের প্রাণ ভোমরা যে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, সেই চলতি মূলধন না পাওয়ায় দেড় বছর ধরে শিল্পটি চালু করতে পারেনি মাকসুদ। হাজার বার ব্যাংকের দরোজায় কড়া নাড়তে নাড়তে মাকসুদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হয়েছে। ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে বেচারা। সংসারে দেখা দিয়েছে বিশাল অসহায়ত্ব। এমনকি ব্যাংকের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের অসহযোগিতা ও দুর্বৃত্তপনায় কপর্দকহীন হয়ে পড়েছে সৎ ও মেধাবী উদ্যোক্তা মাকসুদ। এমনও দিন গেছে যে, স্বামী মাকসুদকে স্ত্রীর কাছ থেকে শুনতে হয়েছে যে, 'কাল থেকে বাচ্চাদের দুধ নেওয়া বন্ধ করে দেবো'।

এমন একটি সময়ে আমি মাকসুদের এই নরক যন্ত্রণার অবসানে কথা বলি সোনালী ব্যাংকের বর্তমান সিইও এবং এমডি, ব্যতিক্রমী, মানবিকতায় উদ্ভাসিত দেশখ্যাত ব্যাংকার ব্যক্তিত্ব ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ-এর সঙ্গে। তাঁর সাথে আমার বন্ধুত্বের সর্ম্পক তিন দশকের পুরোনো, তবে কখনও কোনো কাজে তাঁর কাছে যেতে হয়নি।

মাকসুদের হয়রানি, যন্ত্রণা, বেদনা ও নিপীড়নের সব কথা জেনে-শুনে মাসুদ ভাই অকপটে স্বীকার করলেন- শতভাগ দায় ব্যাংকের। ব্যাংকের কারণেই বেচারা উদ্যোক্তা মাকসুদ আজ সর্বহারা হয়েছে। এরপর শুরু হলো- মাকসুদের প্রকল্পটি বাচাঁনোর জন্যে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের প্রচেষ্টা, আমাদের সংগ্রাম। মাকসুদের প্রকল্পের চলতি মূলধন বা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার যুদ্ধ শুরু করলেন জনাব মাসুদ। একদিকে জনাব মাসুদ যত চেষ্টা করেন সমস্যার সমাধানে ঠিক তার বিপরীতে অবস্থান নেয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট মিড ও লোয়ার লেভেল ম্যানেজমেন্ট। হয়রানি কত প্রকার ও কি কি তার উদাহরণ দেখতে শুরু করলাম আমরা এই সমস্যা সমাধান অভিযানে। এক পর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদকে পর্যন্ত ভুল তথ্য দিয়ে কনফিউজড করে ফেললো ব্যাংকের মিড ও লোয়ার লেভেল ম্যানেজমেন্ট। ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি এমবিএ। তাঁর ধৈর্য ও একাগ্রতা আমাকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করতে লাগলো পদে পদে। পরিচালনা পর্ষদের সভায় মাসুদ ভাই যে দীর্ঘ বক্তব্য ও যুক্তি তুলে ধরলেন তাতে পর্ষদ বুঝতে সক্ষম হলো যে, কিভাবে পিয়ারসন্স এগ্রো তথা এর উদ্যোক্তা মাকসুদকে কঠিন যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছে সোনালী ব্যাংক। প্রায় পাঁচ মাসের দীর্ঘ যন্ত্রণাকর প্রচেষ্টার পর অতি সম্প্রতি দেড় বছরের অচলায়তন ভাঙতে সক্ষম হলেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ভাই। পিয়ারসন্স এগ্রোর চলতি মূলধনের একটি অংশ ডিসবার্স করলো সোনালী ব্যাংক।

প্রায় ২০০ মানুষের কর্ম সংস্থানের এই আমদানী বিকল্প শিল্পটি শুরু করতে যাচ্ছে উৎপাদন। আবার উদ্দীপনা নিয়ে ছুটে চলেছে উদ্যোক্তা মাকসুদ সিকদার, যেন তার পুনর্জন্ম ঘটেছে! ঝাড়-পোছ করে, মেশিনারিজ ও ইক্যুইপমেন্ট-এর সার্ভিসিং শেষে পিয়ারসন্স এগ্রো সহসাই শুরু করবে তার উৎপাদন। আর এ সব কিছুর পেছনে যে মানুষটির অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর নাম মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। মানুষ জন্ম নেয়, মৃত্যুবরণ করে; এই আমাদের জীবন চক্র। এরকম জীবনই যাপন করে ৯৯% মানুষ। এর মধ্যে মাত্র ১% মানুষ তাঁদের মহানুভবতা, মানবিকতা, যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে হয়ে ওঠে 'মানুষ রতন'। সৎ মানুষের প্রতিকৃতি আমার প্রিয় বন্ধু ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ যে তেমন একজন ‘মানুষ রতন’তা আজ বলি দ্যর্থহীন কন্ঠে!
পরম করুণাময় আল্লাহ মাসুদ ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল করুন, আমীন...

সৈয়দ রানা মুস্তফী: সিনিয়র সম্পাদক ও জাতীয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

এ সম্পর্কিত আরও খবর