শিল্পাঙ্গনে দুর্নীতি শিল্পের জন্য মহা ক্ষতি

, যুক্তিতর্ক

মহিউদ্দিন আহমেদ | 2023-08-30 05:39:50

একটি দেশের মুল ভিত্তি যেমন তার রাজনৈতিক আচরণ আর অর্থনৈতিক ভিত্তি, তেমনি একটি জাতির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে তাদের শিল্প ও সংস্কৃতি। আবহমান কাল থেকে মাঠ ঘাট পেরিয়ে বর্তমানের শিল্প সংস্কৃতি সময়ের সাথে তার নিজস্ব শিকড় খুঁজে পেয়েছে। সেই সাথে শিল্প ও সংস্কৃতির প্রসারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এটি খুঁজে পেয়েছে শক্ত ভিত্তি। কিন্তু নিরাশার কথা হলো সেই ভিত্তিতে দুর্নীতির ঘুন পোকা ঝেকে বসেছে। কখনো বেড়ায় ক্ষেত খেয়ে ফেলছে আবার কখনো ফসল যাচ্ছে দুর্নীতি নামক ইঁদুরের পেটে।

হালে যেটি সবচেয়ে বেশী আলোচিত হচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। বিষয়টি অনুসন্ধানে ইতিমধ্যেই মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাকে। অর্থ পাচারের মত গুরুতরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অধিকতর তদন্তের স্বার্থে গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গত দুই অর্থবছরের বাজেট, ব্যয় এবং ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের নথিপত্র চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (ডিজি) লিয়াকত আলী লাকীকে নোটিশ পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সংস্কৃতির উন্নয়নে যেখানে কাগজে কলমে অগ্রাধিকারমুলক কর্মকান্ড নথিভুক্ত হওয়ার কথা সেখানে আজ  আলোচ্য বিষয় শিল্পীদের আপ্যায়নের জন্য তছরুপকৃত  ৪৪ লাখ টাকার খাবারের ভুয়া রসিদ। যাপিত জীবনের ভালো খারাপ বিষয়গুলো যেখানে নাট্যরুপে দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হয়, সেই সংস্থাটি আজ নিজেই দেশবাসীর কাছে চোরের আখড়ার নামান্তর। ধর্মীয় গুরু আর সাংস্কৃতিক কর্মী; এই দুই দলের মানুষকে সমাজে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। তাদের কাছ থেকে মানুষ ন্যায় আর সততা আশা করে। তারা সমাজের পথ প্রদর্শক। নীতি, নৈতিকতা আর সততাকে শিকেয় তুলে তারা যখন দুর্নীতিতে ঝাপিয়ে পরে তখন পুরো সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হয়।

দুর্নীতি নামক বিশাল যে বটবৃক্ষের শীতল ছায়ায় দেশজুড়ে দুর্নীতিবাজদের আস্ফালন চলছে সেটা তো একদিনে মহীরুহে পরিনত হয়নি। গত ৫০ বছরে একটু একটু করে পানি-বাতাস পেয়ে তবেই আলোর মুখ দেখেছে আজকের এই বৃষ বৃক্ষ। কিন্তু সেই অর্থে দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের কার্যকর ব্যবস্থা কই? খবরে উঠে এলে কিংবা কেউ শক্তভাবে অভিযোগ করলেই আমরা কিছু দুর্নীতির খবর জানতে পারি। না হলে সব ঠিকঠাক ভাবেই চলে, মনে হবে কোথাও কোন সমস্যা নেই। এ যেন চোখ বন্ধ রেখে প্রলয়কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

এর আগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের মালপত্র ক্রয়ে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে সেই সংস্থার সাবেক এমডি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ চারজনের বিরুদ্ধে তিন কোটি ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিল। তাতে মামলাও হয়েছিল কিন্তু তারপর কি হয়েছে? এসব মামলা আর তদন্ত যেন ডেইলি সোপের লম্বা কোন সিরিয়াল, কবে শেষ হবে দর্শক জানেনা। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত শিল্পের এসব কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যতটা না নিজের ক্ষতি করেন, তার চেয়ে বহু গুন ক্ষতি করেন পুরো শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনের।

সঠিক চিকিৎসায় ক্যান্সারও ভালো হয়। কার্যকর ব্যবস্থা আর সঠিক তদারকিতে দুর্নীতির লাগামও টেনে ধরা সম্ভব, তবে তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। শুধু খবর বেরুলেই খবর নেয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধে সকল পর্যায়ে নজরদারী বাড়াতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পকলা একাডেমি এবং চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের মত প্রতিষ্ঠানগুলোতে একক ব্যক্তির ক্ষমতা খর্ব করে আর্থিক বিষয়গুলোতে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। তবে এটিও তো ঠিক; শেষ পর্যন্ত যদি নৈতিক মুল্যবোধের প্রসার ঘটানো না যায় তবে পুরো একটি গোষ্ঠী মিলেও দুর্নীতির ছাতার নীচে আশ্রয় নিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। তখন অবস্থা হবে যেই লাউ সেই কদু।

লেখক: সাংবাদিক; কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর