আস্থা ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের সঙ্কট

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-31 13:47:26

আশ্বাসে থেমেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-আন্দোলন। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আটাশ শিক্ষার্থীর আমরণ অনশন আর সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর আন্দোলন এখন পর্যন্ত উপাচার্যকে সরাতে না পারলেও এর একটা আশ্বাস মিলেছে। সরকারের ‘উচ্চমহলের’ সঙ্গে আলোচনার পর ওখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গে রাজি করিয়েছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক অধ্যাপক, শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়ও বটে; একই সঙ্গে তারা আস্থাশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারীও।

জাফর ইকবাল নিজেই জানিয়েছেন তিনি অনুরুদ্ধ হয়ে ওখানে গেছেন। তার ভাষায়, ‘সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের দল তার বাসায় গিয়ে তাকে অনুরোধ জানিয়েছে যাতে তিনি অনশনরতদের অনশন ভাঙান। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শিক্ষার্থীরা যা চায় সেটাই করা হবে।’ সরকারের উচ্চমহলের আশ্বাস পেয়ে তিনি কালবিলম্ব না করে ছুটে গেছেন সিলেটে। অবশ্য তিনি এও বলেছেন এইধরনের আশ্বাস না পেলেও তিনি শাবিতে আসতেন। আমাদের ধারণা তার ওই আসা হয়ত হতো আন্দোলনে সংহতি জানাতে। যদিও গণমাধ্যমে লেখা এক নিবন্ধে তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন আগেই।

এরআগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর একটা ভিডিয়ো কনফারেন্সের খবর আমরা জেনেছি। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা দল গভীর রাতে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে গেছে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর জানা গেল শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ করেছেন, কিন্তু উপাচার্যের পদত্যাগ নিয়ে মন্তব্য করেননি। তিনি আন্দোলনকারীদের বলেছিলেন, তারা যেন তাদের দাবি লিখিতভাবে জানায়। এক দফা দাবিতে একটা আন্দোলনে লিখিতভাবে দাবি জানানোর কী বাকি থাকে সেটা কেউ না বুঝলেও মন্ত্রী লিখিতভাবে দাবি জানানোর কথাই বলেছেন। এরপর তিনি ফের আলোচনায় বসবেন বললেও আর যোগাযোগ করেননি। অবশ্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার আলোচনা না হলেও এই আন্দোলনে তিনি ‘তৃতীয় পক্ষ’ আবিস্কার করেছেন, দেখেছেন তাদের ‘ইন্ধন’ও! শিক্ষা উপমন্ত্রীও আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিকে বলেছেন ‘অযৌক্তিক’। সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এমন অবস্থান শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছিল, এবং এই হতাশা তাদের প্রতি আস্থাহীনও করেছিল।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন শিক্ষার্থীদের প্রতি সুবিচার করেনি। তারা সহমর্মিতা জানাতে এসেছে প্রথম কয়েকদিন, এরপর তারা নিজেরা সরে গেছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে সহমর্মিতা চায়নি, চেয়েছিল সমর্থন; কিন্তু ওটা আসেনি তাদের পক্ষ থেকে। তার ওপর শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের একটা অংশের এক মানববন্ধনে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন নিজেদের ‘বুদ্ধিজীবী শ্রেণির’ দাবি করে বলেছিলেন, ‘..তারা চাষাভুষা শ্রেণির নন যে তাদেরকে যা ইচ্ছা বলা যাবে।’ তার ওই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ করেছিল। ফলে ‘আমরা সবাই সাস্টিয়ান, চাষাভুষার সন্তান’ শীর্ষক স্লোগানও ওঠেছিল আন্দোলনে। শিক্ষকদের এমন অবস্থান আন্দোলন প্রশ্নে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে হালকা করেছিল।

সমস্যা সমাধানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের যে দল শাবিপ্রবিতে গিয়েছিল তাদের মধ্যে নিজ দলেই স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য ক’জন ছিলেন এমন প্রশ্ন খোদ আওয়ামী লীগাররাই করেছেন। সিলেটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের এই অন্তঃসারশূন্যতা এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ওই প্রতিনিধি দলের মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, কিন্তু তার সঙ্গী যারা তারা স্থানীয় রাজনীতিতেই কতখানি প্রভাববিস্তারী এনিয়ে প্রশ্ন আছে। এই দলের বাইরে সিলেট আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতা ছিলেন যারা অন্তত শাবিতে যাওয়া অনেকের চাইতে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে কি দলীয় কোন্দল কাজ করেছে? অথচ এটা শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিনিধি দল ছিল। শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিনিধি দল নিয়েও বিভক্তি; যার প্রভাব কি পড়েনি?

এটাও বলা যাবে না যে, সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের সকল নেতা একসঙ্গে গেলেও আন্দোলনের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বুঝাতে সক্ষম হতেন, তবে অন্তত এই বার্তা যেত শিক্ষামন্ত্রীর যে প্রতিনিধি দল সমাধানের জন্যে যাচ্ছে তারা স্থানীয়ভাবে নিজেদের মহলেও গ্রহণযোগ্য, তাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য আছে, আর ঐক্য আছে বলে তারা শক্তিশালী। মন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের এমন অবস্থা শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে নিঃসন্দেহে, একই সঙ্গে সিলেট আওয়ামী লীগে যে আস্থা রাখা যায় এমন নেতার খুব অভাব সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ এই সিলেটের আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, এম সাইফুর রহমান, দেওয়ান ফরিদ গাজী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, বদরউদ্দিন কামরানরা কেবল সিলেটই নয়, জাতীয় পর্যায়েও আলো ছড়িয়েছিলেন। এখন তাদের মত আস্থাভাজন নেতার সঙ্কট রয়েছে পুরো সিলেটে।

শাবিপ্রবিতে যখন বিপদজনক পরিস্থিতি তখন সিলেটে স্থানীয় নেতাদেরসহ কোন জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য, বিভাগের বিভিন্ন আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হওয়া কারও উদ্বেগ; সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালনে দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়েনি। সবাই কেমন যেন নির্বিকার থেকেছেন। সিলেটে অবস্থিত একটা বিশ্ববিদ্যালয় যখন টালমাটাল তখন বাইরে থেকে তাদের উদ্বেগ হয়ত সমস্যা সমাধানে বড়ধরনের কোন প্রভাব ফেলত না ঠিক, তবে তাদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবান্ধব মানসিকতার প্রমাণ দিত। এটা আমাদেরকে হতাশ করেছে। তবে এরই মাঝে সিলেটের সুধীসমাজ সামান্য হলেও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে; তাদের এই উদ্বেগ বড়ধরনের প্রভাব বিস্তারক না হলেও গুরুত্বের বিচারে কম না কিন্তু!

উপাচার্য, শিক্ষকমণ্ডলী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সাংসদগণ, সিলেট থেকে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া ব্যক্তিগণ, উপাচার্যদের সংগঠন, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক। এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত সরকারকে আস্থা রাখতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর। জাফর ইকবাল দম্পতি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে তারা দুজন যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং আস্থাভাজন অনশন ভঙ্গ এবং এরপর আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা তার প্রমাণ বহন করে।

শাবিপ্রবি পরিস্থিতিতে সরকারকে আয়না মুখ দেখতে হবে। সরকার ও দলের মধ্যে আস্থাভাজন লোকের এই যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, এটা কেন হয়েছে, কী এর সমাধান সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সময় এবং আসছে দিনগুলোতে নানাবিধ ঘটনা ঘটবে তখন এর সমাধানে কারা আসতে পারেন সামনে -তা নিয়েও ভাবতে হবে। আস্থার সঙ্কটকে দূর করে আস্থাভাজন ব্যক্তিত্বের সন্ধান করতে হবে। তা না হলে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, দেশও ক্রমে অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে।

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক, ইমেইল: kabiraahmed007@gmail,com

এ সম্পর্কিত আরও খবর