সিনহা হত্যার বিচারে দেখা মুক্তি

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 00:28:11

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যায় বিচারিক আদালতের রায়ে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের ফাঁসির রায় এসেছে। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে আসা এই বিচারের রায় আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। দেশের একটা প্রান্তের একটা আদালতের এই রায় পুরো দেশের সকল আদালত, সকল বাহিনী, সকল নাগরিক এবং সকল নীতিনির্ধারকের মাঝে ছড়িয়ে যাক—এই প্রত্যাশা আমাদের। এই বিচার অন্য কারণেও উল্লেখযোগ্য কারণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার সচরাচর হয় না। পুলিশ-র‍্যাবসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর হাতে আগে এভাবে অনেকের প্রাণ গেছে। বিচারের দাবি জানানোর সাহস হয়নি অনেকের। উপরন্তু এইধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাকে নাগরিকের একাংশ সমর্থন করে গেছে, যখন যারাই দায়িত্বে তারাও চালিয়ে গেছে-যাচ্ছে, এমনকি জাতীয় সংসদেও কয়েকজন সাংসদের বয়ানে এই বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়াও হয়েছে।

আইন-আদালতকে অবজ্ঞা করে, অবমূল্যায়নের মাধ্যমে কথিত এই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পুলিশ-র‍্যাবের হাতে বিপুল প্রাণের অপচয় হয়েছে। রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীগুলোর এমন কর্মকাণ্ড সচেতন নাগরিকশ্রেণির প্রতিবাদের মুখে পড়লেও এই প্রতিবাদের ভাষা ছিল ক্ষীণ, এই প্রতিবাদ সংশ্লিষ্টদের নাড়া দিতে পারেনি। তারা ছিল নির্বিকার, নির্বিকার ছিল সরকার-নীতিনির্ধারক।

আমরা দেখে আসছি, প্রতিটি ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধ শেষে পুলিশ-র‍্যাবের একই বয়ান। সেই একই বয়ানে মানুষ বিশ্বাস না করলেও বিপুল প্রতিবাদ করেনি, প্রতিবাদের সাহস হয়নি অনেকের; আবার অনেকেই এর সমর্থন করেও গেছে, এখনও করছে। পুলিশ-র‍্যাবের হাতে নিহতদের পরিচয়ের মধ্যে ছোটখাটো অভিযুক্ত থেকে শুরু করে বড় অভিযুক্তের নামও ছিল। ছিল অনেক নিরীহের নামও। আইন-আদালতের বিচারে অভিযুক্তরা ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধী নন যতক্ষণ তা প্রমাণ হয়। কিন্তু কথিত এই বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা যে প্রকৃতই অপরাধী তা প্রমাণের জন্যে বাহিনীগুলো অপেক্ষা করেনি। নিজেদের অপ্রাতিষ্ঠানিক বিচারে কিংবা সিদ্ধান্তে অপরাধী সাব্যস্ত করে তারা গুলি করে মেরেছে। মারার পর গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে ‘দুপক্ষের বন্দুকযুদ্ধের কথা’! প্রতি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ভাষা এক। প্রথম দিকে সকল ঘটনায় কেবলই নির্দিষ্ট ব্যক্তিই মারা যেতেন, এরপর তারা মাঝেমধ্যে পুলিশ-র‍্যাব সদস্যদের কেউ আহত হয়েছিল—এমনটাও দাবি করতে শুরু করে।

অপারেশন ক্লিনহার্টের সময়ে ‘হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু’ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত পুলিশ-র‍্যাবের ভাষ্যের কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে অগণন লোক প্রাণ হারিয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সময়ে-সময়ে এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য দিয়ে থাকে, ধারণা করি প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি ওখানেও। আইন ও সালিশ (আসক) কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮০টি। ২০২০ সালে ২২২ জন এবং ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন নিহত হন। তাদের হিসেবে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৩৬৪ জন। এরআগেও নিশ্চয় নানা নামের এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তবে এখনকার মত গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতি না থাকায় অনেকগুলো নিয়ে আলোচনাই হয়নি। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে ৫০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়৷ এরপর অপারেশন ক্লিনহার্টের ব্যাপারে ‘দায়মুক্তি’ দেয়া হয়। তবে ২০১৫ সালে আদালত ওই দায়মুক্তি বাতিল করে দেয় এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশও দেওয়া হয়। তবে কারা কিংবা কেউ কি আদৌ এই ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন সে তথ্য অজানা আমাদের।

পুলিশ-র‍্যাবের এই ক্রসফায়ার অথবা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো নিয়ে সরব বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। সরকার তাতে পাত্তা খুব একটা দেয়নি। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদের মৃত্যুর পর প্রায় তিনমাস বন্ধ ছিল এই ক্রসফায়ার। এরপর ফের শুরু হয়। সর্বশেষ ডিসেম্বরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর কিছুদিন বন্ধ ছিল এই ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সময়ে-সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় সাময়িকভাবে এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়নি। উপরন্তু এর সপক্ষে নীতিনির্ধারকদের অনেককে যুক্তি দিতেও দেখি। এটা অপ্রত্যাশিত।

পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যমের ধারাবাহিক প্রতিবেদন, সরকারসহ বিভিন্ন বাহিনীর নড়েচড়ে বসার ঘটনা অভাবনীয় ছিল। এর কারণ মূলত সিনহা রাশেদের সাবেক হলেও পেশাগত পরিচিতি। অনেকের ধারণা সিনহা রাশেদ সেনাবাহিনীর কেউ না হলে হত্যাকাণ্ডের পর এতকিছু ঘটত না। এই ধারণা যে মিথ্যা নয় তা প্রমাণিত। একরামসহ অনেক হত্যাকাণ্ডের পর স্পষ্টত বাহিনীগুলোর অন্যায় প্রকাশিত হলেও এনিয়ে এত দূর যাওয়া সম্ভব হয়নি কারও। ‘আব্বু তুমি কাঁনতেছ কেন...’ বাক্যটি নাড়া দিয়েছিল নাগরিকমনকে, নাড়া দিতে পারেনি নীতিনির্ধারকদের!

সিনহা রাশেদের পরিচয়ের কারণে হোক বা ন্যায়বিচারের স্বার্থেই হোক বিচার হয়েছে—এটাই স্বস্তি আমাদের। আমরা চাই, সম-মর্যাদা, সম-অধিকারের যথাযথ বাস্তবায়ন। আইন সকলের জন্যে সমান, এই আপ্তবাক্য প্রতিষ্ঠিত হোক। সিনহা রাশেদ দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে বিচারের যে পথ খুলেছে তা অব্যাহত থাকুক, বিচার পাওয়ার নাগরিক অধিকার অবারিত হোক সকলের জন্যে। একই সঙ্গে বন্ধ হোক বিচারবহির্ভূত সকল হত্যাকাণ্ড। সিনহা হত্যার বিচারে আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্তির পথ দেখি; রাষ্ট্রও দেখুক!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর