আত্মবিশ্বাস: বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!

, যুক্তিতর্ক

ড. হাসিন মাহবুব চেরী | 2023-09-01 02:32:30

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই নীরার মনটা খুব খারাপ লাগছে।  তার চোখের সামনে নিজের জীবনের সব নেগেটিভ কাহিনীগুলো ভেসে উঠছে। কেবলি মনে হচ্ছে, তার বেঁচে থাকার কোনো মূল্য নেই পৃথিবীতে। কারণ তার জীবনে কিছুই তার মনের মতো করে হয়নি। 

নীরার মতো এরকম সময় কম বেশি আমাদের সবার জীবনেই এসেছে।  কারো জীবনে এই অবস্থা পাকাপাকিভাবে রয়ে গেছে আর কেউ এই অবস্থা থেকে নিজেকে সাফল্যজনক ভাবে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে।

এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্যটা হলো তাদের আত্মবিশ্বাস-এর পরিমাণের। এখন প্রশ্ন হলো আত্মবিশ্বাস জিনিষটা আসলে কি? আত্মবিশ্বাস হলো নিজেকে মূল্যবান মনে করা, নিজের মন থেকে বিশ্বাস করা যে, আপনি নিজেকে সুখী করতে যা করা প্রয়োজন সেটা একাই করতে সক্ষম এবং এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আপনার মনের চিন্তাকে বাস্তবে পরিণত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

অন্যভাবে আত্মবিশ্বাসকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে প্রাচীন ও সুপরিচিত বাংলা প্রবাদের মাধ্যমে। আত্মবিশ্বাস হলো, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর! বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হলে তা আরো স্পষ্ট হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে মানুষ সাধারণত তিন উপায়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকে:

১. জন্মগতভাবে জিনগত কারণে যারা আত্মবিশ্বাসী;

২. ছোটবেলায় তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে যারা আত্মবিশ্বাসী;

৩. নিজেকে ট্রেনিং দিয়ে যারা আত্মবিশ্বাসী। 

প্রথম দুটি কারণ আমাদের কন্ট্রোলে না থাকলেও তৃতীয় কারণটি কিন্তু পুরোপুরি আমাদের হাতে। বিজ্ঞানীদের মতে, আত্মবিশ্বাস এমন একটি দক্ষতা যেটিতে আপনি নিজে নিজেকে ট্রেইন করলে আপনার জীবন পজিটিভ ভাবে বদলে যেতে বাধ্য।  মনে রাখবেন, আপনার জীবনের বর্তমান অবস্থা এসেছে আপনি জীবনে যেসব চয়েস মেক করেছেন এবং আপনি জীবনে কোনো রিস্ক কিংবা নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে কিভাবে রিএক্ট করেছেন, তারই ফলাফল স্বরূপ।  এবং একই ভাবে রিভার্সিবল প্রক্রিয়ায় নতুন চয়েস মেক করে, নতুন রিস্ক বা চ্যালেঞ্জ নিয়েই কেবলমাত্র এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।  আর এজন্যে প্রয়োজন প্রচুর আত্মবিশ্বাস। 

কিন্তু নানা কারণে আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিতে পারে।  তার মধ্যে অন্যতম কিছু কারণ হলো, বাবা মা যদি ছোটকালে আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে থাকেন, অথবা আমাদের বন্ধু-বান্ধব আমাদের সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে আমাদের ছোট করে থাকে, অথবা আমরা যদি জীবনে কারো কাছে প্রতারিত হয়ে থাকি, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যের সাফল্যে দেখে আমাদের  নিজেদের যদি অসফল বলে মনে হয় অথবা মানুষ আমাদের খারাপ ভাবছে, এই চিন্তা যদি আমাদের মনকে গ্রাস করে ফেলে, তা হলে আমাদের আত্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত বা ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ব্যক্তিমানুষের জন্য একান্তই জরুরি। আর এহেন বিরূপ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আত্মবিশ্বাসের জায়গায় ফিরে আসারও কিছু উপায় রয়েছে। এজন্য আপনাকে নিচে বিষয়গুলোকে আপনার চিন্তায় ও জীবনে প্রতিফলিত করতে হবে। যেমন:

১. নিজেকে নিজে মূল্য দিতে শিখুন। মনে রাখবেন আপনি যদি নিজে নিজেকে মূল্য না দেন তাহলে অন্যের কাছে নিজের মর্যাদা চাইবার কোনো অধিকার আপনার নেই।

২. নিজের জীবনে কিছু স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করুন, যার সাথে আপনি কোনো ভাবেই কম্প্রোমাইজ করবেন না। যেমন, আপনি কোনো ভাবেই অন্য কারো দ্বারা আপনার অপমান সহ্য করবেন না, সেই ব্যক্তি আপনার যত ভালোবাসার মানুষই হোক না কেন।  মনে রাখবেন, আপনাকে যে ভালোবাসবে সে কখনোই আপনার অমর্যাদা করবে না।  অথবা আপনার যদি মনে হয় আপনি ক্যারিয়ারে ভালো করলে সুখী হবেন তাহলে সে ক্ষেত্রে যদি কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেটা মুখ বুজে সহ্য করবেন না।  সুতরাং, নিজের স্ট্যান্ডার্ডের বাইরে যেকোনো কিছুকে শক্ত গলায় ‘না' বলতে শিখুন।

৩. নিজে নিজের ভালো দিকগুলো খুঁজে বের করুন এবং নিজের কাছে একান্তে নিজের প্রশংসা করুন।  আমরা সবসময় মনে করি নিজে নিজের কেন প্রশংসা করবো, প্রশংসা তো করবে অন্য লোকে। কারণ আমাদের ছোটকাল থেকে শেখানো হয়েছে ‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’ তাই নিজের প্রশংসা পাবার আশা আমরা অন্যের উপর  ছেড়ে দিয়ে সেটা না পেয়ে আশাহত হয়ে যাই। মনে করতে থাকি, আমরা আসলে প্রশংসারই যোগ্য নই।  কিন্তু সত্যি কথা হলো, আপনি অনেক বেশি প্রশংসার যোগ্য হলেও অনেকেই আপনার প্রশংসা করবে না। কারণ অন্যের প্রশংসা করতেও যোগ্যতা লাগে, যেটা সবার থাকে না।  তাছাড়া অনেকেই আপনার গুণি হিংসাত্মক হয়েও আপনাকে ছোট দেখানোর চেষ্টা করবে।  সুতরাং অন্যের উপর নির্ভর না করে নিজে নিজেকে ভালোবাসুন, নিজে নিজের ভালো গুণ বা এচিভমেন্ট গুলোর প্রশংসা নিজের কাছেই করুন।  দেখবেন আপনি অনুভব করতে পারবেন যে আপনি আসলেই অনেক কিছু করতে সক্ষম যেটার ক্রেডিট আপনি নিজে নিজেকে কোনোদিনই দেননি।

৪. আত্মবিশ্বাসী হতে হলে আপনাকে আপনার জীবনে কোন জিনিষটা আপনার সুখী হবার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে  সেটা খুঁজে বের করতে হবে।  সেটা হতে পারে আপনার ক্যারিয়ার, অথবা আপনার পরিবারের মানুষ অথবা আপনার আর্থিক অবস্থা, অথবা আপনার নিজের কোনো বদভ্যাস, এরকম আরো অনেক কিছু, যেগুলোকে চিহ্নিত ও কঠোরভাবে নির্মূল করুন নিজের জীবন ও আচরণ থেকে।

৫. আপনার নিজে নিজেই কল্পনা করতে হবে যে, এই বাঁধা যদি আপনার জীবনে না থাকে তাহলে আপনার জীবনটা কেমন হবে।  বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, আমাদের ব্রেইন ভিজ্যুয়াল কোনো বিষয় সবচেয়ে বেশি মনে রাখতে পারে, তাই সেই লক্ষ্যে কাজ করতে আপনার ব্রেইনকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই আপনার কল্পনায় সেই সুসময়ের কথা সবসময় ভাবতে হবে। 

 

৬. আপনার স্বপ্ন পূরণে যে  কারণগুলো বাঁধা হিসেবে আছে একে একে তাদের আপনার জীবন থেকে অপসারণ করার জন্যে পজিটিভ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক বাঁধা বিপত্তি আসবে কিন্তু  মনে রাখবেন শুধুমাত্র প্রচন্ড প্রেসারের কারণেই কিন্তু কালো কার্বন ঝকঝকে মহামূল্যবান ডায়মন্ডে রূপান্তরিত হয়। আর রিসার্চে দেখা গেছে, মানুষ নিজের ব্রেইনকে যত কঠিন সমস্যার মধ্যে দিয়ে নেয়, ব্রেইনের নিউরোনগুলোর মধ্যে কানেক্শন ততোটা বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ ব্রেইনের কার্যক্ষমতা ততো বেশি বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ ততো বেশি যেকোনো পরিস্থিতিতে সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়। 

৭. আপনি যখন নিজেকে ডিসিপ্লিনের মধ্যে রেখে, ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে পরাজিত হয়ে, একসময় সাফল্য লাভ করতে শুরু করবেন, তখন দেখবেন আস্তে আস্তে আপনার আত্মবিশ্বাসটাও অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

৮. এই পুরো প্রসেসে, যেসব কাছের বা দূরের মানুষ আপনাকে নেগেটিভ কথা বলে লক্ষ্য অর্জনে নিরুৎসাহিত করে, তাদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। কেননা এরা কেবলি আপনাকে পেছনে টেনে নেবে, সামনে এগোতে দেবে না। 

প্রত্যেকের মনে রাখা উচিৎ যে, তার জীবন নামক জাহাজের ক্যাপ্টেন সে নিজেই।  সুতরাং সে নেগেটিভ চিন্তা করে আর হা-হুতাশ করে এই জাহাজটা ডুবাবে নাকি সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে জাহাজ তার নির্ধারিত গন্তব্যে ভেড়াবে, এই সিদ্ধান্ত কিন্তু সম্পূর্ণই তার নিজের হাতে। জীবনে চলার পথে যত নেগেটিভ অভিজ্ঞতাই আপনার জীবনে আসুক না কেনো, সেগুলোকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে যাত্রার নামই সফল জীবন। আর জীবনে কখনোই কোনো অবস্থা পার্মানেন্ট নয়।

ভুলে যাবেন না, হ্যারী পটারের বিখ্যাত লেখিকা জে. কে. রোওলিং তার প্রথম বই ব্লুমসবারি পাবলিকেশন থেকে পাব্লিশ হবার আগে এই স্ক্রিপ্ট আরো ১২ টি পাব্লিশিং হাউসকে জমা দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আত্মবিশ্বাস হারাননি বলেই ৩২ বছর বয়সে সফল ভাবে তার প্রথম বই বের করতে সক্ষম হন এবং নিজেকে সরকারের গরিব ভাতায় চলা একজন অবহেলিত মানুষের জায়গা থেকে পৃথিবীর প্রথম বিলিয়নিয়ার লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন! মহাত্মা গান্ধী বলেছেন:

‘Your beliefs become your thoughts,

Your thoughts become your words,

Your words become your actions,

Your actions become your habits,

Your habits become your values,

Your values become your destiny.’

তাই নিজেকে ট্রেইন করে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনুন। নিজের স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় পায়ে সামনে এগিয়ে যান। দেখবেন আপনার চারিদিকের পৃথিবীটাই বদলে গেছে। আপনিও বদলে যাবেন ইতি ও গতির পথে। এমনকি, গুণবাচকভাবে বদলাতে পারবেন নিজেকে, প্রিয়জন, পরিবার, এমনকি পৃথিবীকেও।

ড. হাসিন মাহবুব চেরী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাইক্রোবায়োলজিস্ট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর