যে মাটিতে আছাড় খাই সে মাটি আঁকড়ে দাঁড়াই

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | 2023-08-31 14:28:34

আমরা বিশ্বাস করি মানুষ মাটির তৈরি। চামড়ার মধ্যে আঁচড় দিলে দেহের ভেতর থেকে মাটির মত রং বের হয়। পানি দিয়ে ধুয় বা তৈলাক্ত পদার্থ দিয়ে সেটা নিমিষেই মুছে ফেলা যায়। অর্থাৎ পরিবর্তন ঘটানো যায় মাটির মানুষের দেহের মধ্যে, মনের মধ্যে। আরো পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব মানুষের চিন্তা-চেতনা, মানসিকতা ও জ্ঞান-গরিমার মধ্যে। একটি নেতিবাচক অবস্থা থেকে একটি ইতিবাচক অবস্থা তৈরি করাটাই যেন এই মাটির মানুষের চিরায়ত কমানা। ইতিবাচক অবস্থা সূচিত করার মাধ্যমে মাটির মানুষের জীবন হয়ে উঠে স্বার্থক।

মাটির মানুষ কথাটি বলতে ও শুনতে ভাল শোনায়। কারণ, এর অর্থটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে। মাটির মানুষের দেহের মধ্যে একটি মন আছে, একটি হৃদয় আছে। এই মাটির মানুষ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবন বায়ু লাভ করে বেঁচে থাকে। সে জীবন নিয়ে কত গল্প, কত গান তৈরি হয়। কত আশা-ভরসা, নিরাশা হতাশা, কষ্ট, রোগ-শোক, হিংসা বিদ্বেষ জন্ম নেয়। আবার কত সহানুভূতি জন্মে, কতশত ভালবাসার রঙ্গীন স্বপ্ন জীবনটাকে গতিশীল করে, করে মহীয়ান। কেউ কেউ  হয়ে উঠেন মহামানব।

মানুষের আদি পেশা কৃষি মাটিতেই শুরু হয়েছিল। সেই পেশা আজও মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপজীব্য হিসেবে বিবেচিত। কারণ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সকল খাদ্যের জোগান আসে মাটি থেকে।

আমরা মাটিতে আবাদ করি, ঘর বানাই। ঘুমাই, জেগে উঠি। বাঁচার অনুপ্রেরণা পাই। সেই এক টুকরো মাটি এখনও কারো কারো জন্যে দুষ্প্রাপ্য। অনেকের পায়ের নিচে মাটি থাকলেও সেটা অন্যের, তার নিজের কোন মাটি নেই। নিজের কোন ভিটেমাটি নেই। আবার অনেকের একপ্রস্থ ঘর থাকলেও যে মাটির উপরে সে ঘর তার উপর নিজের কোন স্বত্ব নেউ, নেই কোন অধিকার। এমনকি নেই কোন পৈত্রিক বা আইনগত অধিকার। আধনিক শহুরে সমাজে জমির মালিকানা স্বত্ত ছাড়াই অনেকের শুধু ফ্লাটবাড়ি নামক শূন্যে আবাসন রয়েছে। কেউ কেউ মহাশূন্যেও মাটি ছাড়া আবাসন কেনার জন্য বায়নার টাকা পরিশোধ করে বসে দিন গুজরান করছেন। তারা তাদের জীবদ্দশায় মহাশূণ্যের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত আবাসনে কখনও বসবাস করার সুযোগ পাবেন কি-না তা জানেন না।

মাটিই মনোবল যোগায়। মাটির সঙ্গে যেসব মানুষের সংযোগ রয়েছে তারা নাকি সুস্থ-সবল দেহ-মন নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পান বলে অনেকে মনে করেন। মাটিতে অগণিত ক্ষতিকর জীবাণু তৈরি হয় আবার অগণিত উপকারী জীবের  জন্ম হয়। মাটিই অসুখ, মাটিই বিসুখ। মাটিই জীবন আবার মাটিতেই মরণ।

মাটিতে বিশতলা দালানের উপর মৃত্যুবরণ করলেও মূলত পোড়া মাটিতেই মরি, সবাই কাঁচা মাটিতে নামিয়ে নিথর দেহটাকে মাটিতে ঢেকে দেয়। মাটিতে মিশে সবাই একদিন হারিয়ে যাই। পানিতে ডুবে বা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হলে বা বাতাসে ছাই হয়ে উড়ে গেলেও সেটাও ভেসে ভেসে একসময় মাটিতে এসে আঁছড়ে পড়ে। মানুষকে মাটিতে মিশতেই হয়। সেজন্য মাটিই প্রথম মাটির মানুষকে বাগে পেয়ে জোরে হাড়-হাড্ডি চাপিয়ে প্রচন্ড শাস্তি দেয় বলে কোন কোন ধর্মীয়ভাবে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।

আমরা অনেকেই মৃত্যুর পরে পুনুরুথ্থানে বিশ্বাস করি। হাশর-নশর নিয়ে চিন্তা করি। একটি কবরের উপর ৭০টি কবর হবে বলে শুনি ও বিশ্বাস করি। তাহলে সমুদ্রগুলো কি এক সময় শুকিয়ে মাটি হবে এবং মাটিগুলো কি সমুদ্র হয়ে যাবে? সেটা অনেক চিন্তার ব্যাপার। তাহলে এজন্য এই পৃথিবীটাকে কতদিন টিকে থাকতে হবে?

কোন একজন মানুষ তার বংশের চৌদ্দপুরুষের কতজনের নাম জানেন? মাত্র ১০০ -২০০ বছর পূর্বে এই ভিটে-মাটিতে কে ছিল তা কেউ ঠিকমত জানেন কি? আপনি যে বসত ঘরে ঘুমান সেখানে ২০০বা ৫০০ বছর আগে কে ঘুমাতো? বাঘ, সাপ না হাতি? নাকি ভুত প্রেত কিছু? শিউরে উঠে শরীরটা আপনার এগুলো মনে হলে? এই পৃথিবীতে এ পর্যন্ত মোট কতজন মানুষ জন্ম নিয়েছিল তার কি কোন লিখিত হিসেব কোথাও আছে? মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর লিখিত ইতিহাস কতজন মানুষ সম্পর্কে জাদুঘরে বা গ্রন্থে রক্ষিত আছে? যে কয়জনের আছে সেটা নিশ্চয়ই যৎসামান্য। অথবা কোনটা বেশ ভ্রান্তিপূর্ণ।

একদিন সব মানুষের নাম হবে মৃতব্যক্তি। সবাই তড়িঘড়ি করে তাকে মাটির নিচে লুকিয়ে দেবে। নতুবা ছাই করে দিলেও সেটা একসময় উড়ে ধুলো-বারিতে মিশে মাটিতেই বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্বাসীদের মতে মাটির উপরেই সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে। মাটিতে দাঁড়িয়ে রেখে সবার বিচার করা হবে। সবার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজেরই সেই বিচারের জন্য সাক্ষ্য দেবে বলে জানা যায়।

বিশ্বাসীদের মতে একদিন বিচার হবেই। অবিশ্বাসীদের জন্য আজকের এই লেখার কথাগুলো অলিক মনে হলেও তারাও সেটা সত্যি করে বলতে পারবেন কি-না তা অস্বীকার করতে পারবেন না। এটাই বাস্তবতা। কারণ,মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সেখানেই।

বিশ্বাসীদের মতে একদিন শিঙ্গায় ফুঁ দিলে মাটি ফুঁড়ে সবাই হঠাৎ জেগে উঠে বাইরে বের হয়ে আসবে। সেটাও নিশ্চয়ই মাটির উপরে। সেগুলো হয়তো পরের কথা। কিন্তু কেউ কেউ বলে থাকেন, কাল কেয়ামত হবে। একথা জ্ঞান হবার পর থেকে শুনে আসছি।

তবে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী সবার জন্যই এ্ই নশ্বর পৃথিবীর যে কয়দিন এই মাটির উপরে বসবাস ও রিজিক আছে সে কয়দিন নিয়েই আমাদের জীবনকাল। আমাদের শুরু, আমাদের সংযুক্তি ও শ্রমপ্রচেষ্টা।

আমাদের নিত্য যোগাযোগ, সমন্বয়, জবাবদিহিতা, প্রশিক্ষণ পরিশ্রম, চাকরি, জীবিকা না হলে চলবে কেমনে? মাটি না হলে রাস্ত্ বানাবো কোথায়? রেল বা গাড়ি চলবে কোথায়? সকাল বিকাল দুপুর হাঁটবো কোথায়? আমাদের চিন্তা চেতনা কোথায় সৃষ্টি হয়? এগুলো বইয়ে লেখা থাকলেও সেসব আসল বই কোথায়?

আজকে যা ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে আগামী ৫০০ বছর পর তা কোথায় পাওয়া যাবে? ইন্টারনেট তো জাদুঘরে রাখার মত জিনিষ নয়। কারণ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ ৫০০ বা ১০০০ বছর পরে কেমন হবে?  সে সময় এসব সেঁকেলে হয়ে যাবে নতুবা চালু থাকবে তো? জাদুঘরের সব জিনিষ পেতে হলে এখনও মাটি খুঁড়ে বের করে গবেষণা করা হয়। তার কতটুকুই বা বের করতে পেরেছে আমরা আর কতটুকুই বা পারবো ভবিষ্যতে? সবই ভীষণ চিন্তার বিষয়!

পড়াশুনা, গবেষণা, জ্ঞানার্জন চলে মাটিতেই। এর শুরুর সময়টা বেশ কঠিন। এ সময় অবিচল থাকাটাই মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে। যার সেটা জাগ্রত হয় সেই সফলকাম হয়।

মানুষ সবচে অসহায় অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। গাভীর বাছুরটি জন্ম নিয়ে এক মিনিট পরেই উঠে দাঁড়ায়। তারপর দৌড়ায়, নিজে মায়ের দুধে মুখ লাগিয়ে খায়। কেউ তাকে শেখায়নি। মানুষকে শেখাতে হয়। মানব শিশুকে তুলে খাওয়াতে হয। কোলে নিতে হয়। আরো কত কিছু!

যুদ্ধ, মারামারি, হানাহানি, হিংসা, প্রতিহিংসা। ভালবাসা, শান্তি, সুখ, সাফল্য সবকিছুই মাটির উপরেই সংঘটিত হয়। কেউ মাটির উপরে পেশী ফুলিয়ে ভয় দেখালেও মাটির নিচে লুকানোর পর সেই পেশী পোকার দখলে চলে যায়। মানুষর দেহটা হয়ে যায় একটা পোকার কুন্ডলী। তারপর বাকী থাকে হাড়-হাড্ডি ও কঙ্কাল। অবশ্য মহামানবদের মৃতদেহ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। সেকথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই না।

আমি শুধু জীবিত মানুষের কথা বলছি। বহু জীবিত মানুষ পেশীতে- জ্ঞানে-শক্তিতে অলসতা পরিহার করি না। অন্যায়-অপরাধ করতে কুন্ঠিত হই না। তবে একদিন না একদিন কোথাও এই মাটির উপরেই চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেলি। তবুও জোর করে চলতে গিয়ে এই মাটিতে পিছলে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলি। এ নিয়ে নানা জোকসও রয়েছে।

প্রবাদে বলে- শিশুরা খেলে মায়ের কোল উঠতে চায়। কিশোর-কিশোরীরা খেলে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে যায়, পালিয়ে যায়।

যুবক-যুবতিরা খেলে ভীষণ লজ্জা পায়। বুড়োরা খেলে কোমর বা পা ভাঙ্গে। সেটাই হচ্ছে- আছাড় খাওয়া বা ফল-ডাউন। এতে অনেক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা হয়। তখন নেড়ে বেলতলা দিয়ে একবারই যায়। মানুষের প্রাকৃতিক শিক্ষা শুরু হয় এটা থেকে। আমরা কেউ না কেউ প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আছাড় খাই। সেটা নানাভাবে নানা কারণে নানা জায়গায় হতে পারে।

আমরা কেউ অন্যকে আছাড় দিই। কেউ নিজে কারণে-অকারণে অন্যের কাছ থেকে আছাড় খাই। আমরা কেউ কেউ অপরের হক কেড়ে নিই। সেটাও দুর্বলদেরকে একধরণের আছাড় মারা বোঝায়।

আমরা ওজন বুঝে ভজন দেখাই বা দেখাই না। তাই অনেক জায়গায় ধরা খাই। দু:খ পাই, কষ্ট পাই। শুধরে নেবার চেষ্টা করি। এই মাটিতেই তার বিচার হয়, অবিচার হলে তারও আবার আরো একদিন বিচার হবে। এই নশ্বর পুথিবীর সকল বিচারপতিদেরও একদিন বিচার হবে। যে মাটিতে মানুষ কারণে-অকারণে আছাড় খায় সেই মাটি মানুষকে একদিন কোলে তুলে নেয়, দেয় আশ্রয়। তবে তা খারাপ মানুষদের জন্য সাময়িক হলেও শুধু ভাল মানুষদের জন্য অনন্তকালের প্রযোজ্য।

তবে- কেউ কেউ এসবের মোটেও ভয় করে না। এ থেকে কোন শিক্ষাও নেয় না। তাদের মুখ হাত সমানে চলে। এর পরেও জোর দিয়ে বলা চলে- যে মাটিতে আমরা আছাড় খাই সে মাটি আঁকড়ে পুনরায় দাঁড়াই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, অমোঘ বিধান। প্রকৃতির এই জ্ঞানতত্ত্ববিদ্যা বা ওনটোলজির এই প্রচেষ্টা চালাতে জানার জন্যই মানুষ অন্য যে কোন অবলা প্রাণি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওমিক্রনের সংক্রমণও সেখানে তেমন মৃত্যুভীতির সঞ্চার করে না। সেখানেই মানুষের জীবন, সেখানেই চলৎশক্তির আধার।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর