ইউরোপে লং ড্রাইভ সমাচার

, যুক্তিতর্ক

ড. হাসিন মাহবুব চেরী | 2023-08-31 16:11:09

 

কাজের কারণে আমাকে অনেক লং ড্রাইভ করতে হয় প্রতিনিয়ত। ইউরোপের জীবনপ্রবাহে লং ড্রাইভ নৈমিত্তিক বিষয়। হলিউড ফিল্মের রোমান্টিক লং ড্রাইভ নয় মোটেই। কিংবা টুরিস্ট হটস্পটে বা হানিমুন ডেস্টিনেশানে যাওয়ার মতো লাইভ টাইম মেমোরিও নয়। লং ড্রাইভ পশ্চিমের ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকান জীবনে এক অপরিহার্য অংশ।

লং ড্রাইভ যানজটের কষ্টকর স্মৃতি বা বিড়ম্বনা দেয় না ইউরোপে। বরং এতে অভিজ্ঞতার ঝুলিও দিন দিন সমৃদ্ধ হয়। সর্বশেষ লং ড্রাইভের অভিজ্ঞতাটা ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। ভোর বেলা ল্যাবে ঢুকে সারাদিন কাজ শেষে যখন প্রচন্ড টায়ার্ডনেস আর বিরক্তি নিয়ে ড্রাইভ করছিলাম তখন ধূম করে গেলো আমার গাড়ির টায়ারটা ফেটে! একদম যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয় টাইপ অবস্থা। তখন  রাত বাজে ১০ টা,  আমি মোটরওয়ে তে ছিলাম।  এখানে মোটরওয়েতে রাস্তার পাশে ইমার্জেন্সি গাড়ি থামানোর জন্যে জায়গা থাকে, যাকে বলা হয় ‘হার্ড শোল্ডার’।  এই হার্ড শোল্ডারে একটু পর পর নাম্বার দেয়া পিলার গাঁথা থাকে, যাতে করে মানুষ এতবড়ো মোটরওয়েতে তার নিজের অবস্থানটা কোথায় তা নির্ণয় করতে পারে, আবার টেলিফোনও লাগানো থাকে, যাতে করে যদি কারো সাথে ফোন না থাকে তাহলে তারা যেন ইমার্জেন্সি সার্ভিসকে ওই ফোন থেকে কল করে সাহায্য চাইতে পারে। 

যাই হোক, আমি গাড়িটা  হার্ড শোল্ডারে ইমার্জেন্সি লাইট জ্বালিয়ে থামালাম।  তারপর আমার গাড়ির ইমার্জেন্সি কল বাটনে চাপ দিতেই মার্সেডিজের রেসকিউ সার্ভিসে কল চলে গেলো।  তারা আমার অটোমেটিক গাড়ির প্রোগ্রাম থেকে সাপ্লাই করা ডাটা নিয়ে প্রথমেই আমার অবস্থান কনফার্ম করলো। তারপর আমাকে বললো, গাড়ি থেকে বের হয়ে নিরাপদ অবস্থানে দাঁড়াতে এবং আমাকে জানালো যে, যেহেতু আমার মোটরওয়েতে গাড়ির সমস্যা হয়েছে, সুতরাং আমি তাদের হাই প্রায়োরিটি। 

কেননা, নির্জন মোটরওয়েতে অনেক বড় বড় লরী যায়। তাই রাস্তার পাশে এভাবে গাড়িতে বসে থাকা নিরাপদ নয়।  তারা আমাকে আমার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার কথাও জিজ্ঞেস করে জানলো যে, আমি কি সব দিক থেকে ঠিক আছি কিনা, এরকম অবস্থায় টেনশন ফীল করছি কিনা।  তারপর তারা আমাকে বললো যে,  যেহেতু তাদের কাছে আমার গাড়ির স্পেয়ার চাকা নেই, সুতরাং আমাকে সহ পুরো গাড়ি রিকভারি ট্রাক পাঠিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে।  এবং আগামীকাল আবার রিকভারি ট্রাক এসে গাড়ি গ্যারাজে নিয়ে চাকা লাগিয়ে আনবে। আর আমাকে উদ্ধার করতে রিকভারি ট্রাকের আসতে সময় লাগবে ৫০ মিনিট। 

এই ৫০ মিনিট সময়ে রেসকিউ সার্ভিস থেকে আমাকে ৪ বার কল দিয়ে আমি নিরাপদে আছি কিনা সেটা নিশ্চিত করেছে ও আমার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রেখেছে। তারপর রেসকিউ ট্রাক একদম সময় মতো ঠিক ৫০ মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির।  ড্রাইভার এসেই আগে জানতে চাইলো আমি সুস্থ্য আছি কিনা। তারপর আমাকে নিরাপদে গাড়ি থেকে বের করে এনে রাস্তার পাশে নিরাপদ জায়গায় দাঁড় করিয়ে গাড়ি প্রথমে ট্রাকে তুললো। আমাকে শীতের রাতে ঠান্ডায় দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে বার বার ক্ষমা চাইলো। এবং বুঝিয়ে বললো  যে, সে আমাকে গাড়ি ট্রাকে লোড করার সময় ট্রাকের ভেতর বসতে দিতে পারবে না কারণ কোনো কারণে যদি গাড়ি ট্রাকে ওঠানোর সময় কোনো এক্সিডেন্ট হয় তাহলে সেটা আমার জন্যে বিপদজনক হবে। 

তারপর গাড়ি ট্রাকে উঠিয়ে ড্রাইভার আমাকে ট্রাকে ওঠানোর আগে জানালো যে ট্রাকের ভেতরে চারিদিকে সিকিউরিটি ক্যামেরা লাগানো আছে সুতরাং আমি যেনো ট্রাকে উঠতে ভয় না পাই। ট্রাকে উঠে আমি বসে বসে ভাবছি, বাংলাদেশে এই একই ঘটনাটা হলে আমার কি পরিমাণ ভোগান্তি হতো! একটা উন্নত দেশ যে তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থ্যা কতভাবে নিশ্চিৎ করে সেটা আসলে এক্সপেরিয়েন্স না করলে বোঝানো যাবেনা।

শুধুমাত্র কাজের প্রতি নিবেদিত এদের সার্ভিসের কারণে এতো বিরক্তিকর ও বিপদজনক একটা ঘটনার পরেও আমার ভোগান্তিটুকু অনেকটাই কমে গেলো! আমাদের দেশে এই রকম নাগরিক নিরাপত্তা এবং সুযোগ সুবিধার আশা আদৌ কোনোদিন কি কল্পনা করা যাবে? নাকি তা শুধু অলীক কল্পনা আর ভাষণ-বক্তৃতার মধ্যেই রয়ে যাবে?

ড. হাসিন মাহবুব চেরী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাইক্রোবায়োলজিস্ট, শিক্ষক ও গবেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর