নির্ভীক ও ছাত্র দরদী শিক্ষক শহীদ শামসুজ্জোহা

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. একরামূল ইসলাম | 2023-08-31 18:01:33

১৯৬৯ সালের ১৮-ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর এবং রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তানি বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে । তার এ মর্মান্তিক মৃত্যু বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলকে স্তম্ভিত এবং হতবাক করে দিয়েছিল। প্রতি বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিনটি  ‘শিক্ষক দিবস’ হিসাবে পালিত হয়।

সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালে ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে, বাঁকুড়া জিলা স্কুলে তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হন। এরপর বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণীতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে বিএসসি (সম্মান) এবং ১৯৫৪ সালে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুজ্জোহার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালে ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে এবং একই বছর তিনি রসায়ন বিভাগের প্রভাষকও হন। পরে তিনি রসায়ন বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ১৯৬৮ সালের ১ মে ড. জোহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ড. জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় সাহসিকতার সাথে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিলে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রশালায় ভাষা আন্দোলনের উপর সংগৃহীত ছবিতেও তার উপস্থিতি দেখা যায়।  

পাকিস্তান আমলে তৎকালীন সরকার পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে। ১৯৬৮ সালে দায়ের করা “আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে” এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই  অভিযোগে ১৮ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর সাধারণ  জনতা তখন দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি -আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। প্রতিবাদী জনতা ও ছাত্রসমাজকে মোকাবিলার জন্য ঐ দিন রাজশাহীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কারফিউ ভঙ্গ করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গাড়ি নিয়ে ছুটে যান ড. জোহা এবং আহত ছাত্রদের চিকিৎসার জন্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

ঐ দিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকা এক জরুরি সভায় তিনি বলেন- আমি গর্বিত, আহত ছাত্রের পবিত্র রক্ত আমাকে স্পর্শ করেছে। এরপর যদি গুলি করা হয় কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে আমার বুকে যেন তা লাগে। পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে শহরের দিকে যাওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে পৌঁছলে সেখানে মোতায়েন করা সেনাবাহিনী সেই মিছিলে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। সেখানে উপস্থিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহা ছাত্রদের শান্ত করার ও ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ গুলির শব্দ!! গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়া দেহটি ছিল ড. জোহার। A great teacher is like a candle - it consumes itself to light the way for others. ছাত্রদের নিরাপদ স্থানে ফিরিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করেছিলেন কিন্তু নিজে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারেননি। আহত অবস্থায় মেইন গেট থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পর সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে জানাজা শেষে প্রশাসন ভবনের সামনে সমাধিস্থ করা হয় শহীদ শামসুজ্জোহাকে।

ড. জোহার রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার পিছু হটতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সাথে সাথে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল কারাবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। পরেরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলায় অভিযুক্তদের এক গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। একই দিনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান' নামক এই গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে মার্চ পতন ঘটে সামারিক জান্তা আইয়ুব খানের। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভীতও রচিত হয়েছিল ড. জোহার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ড. জোহাকে। কিন্তু ড. জোহার ইতিহাস কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ।শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৮-ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। ড. জোহার শাহাদাতের দিনটিকে দীর্ঘদিন ধরে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্বের সর্বমোট ১৯টি দেশে অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ ‘টিচার্স ডে’ পালিত হয়। ভারতে ৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে স্বতন্ত্র ‘শিক্ষক দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। ড. জোহা একজন নির্ভীক, ছাত্র দরদী শিক্ষক। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে শিক্ষক সমিতির এক মত বিনিময় সভায় ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। কিন্তু অদ্যাবদি সরকারের নিকট থেকে এ ব্যাপারে কোনো সাড়া মেলেনি। আমরা আবার ও দিবসটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার জোর দাবি জানাচ্ছি।

রাবি ক্যাম্পাসে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সামনে রয়েছে স্মৃতি ভাস্কর্য “স্ফুলিঙ্গ”। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনের সামনে শহীদ শামসুজ্জোহার সমাধিতে জোহা স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে যা ‘জোহা চত্বর’ হিসেবে পরিচিত। উদ্যোগ নেয়া  হচ্ছে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে “জোহা কর্নার” স্থাপনের। ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ ও অবদান, তার উপর রচিত বই সমূহ,  ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত তথ্য,  মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আলোকচিত্র  ইত্যাদি এই কর্নারে স্থাপন করা হবে। এবারের জোহা দিবসে শহীদ শামসুজ্জোহা হল কর্তৃক আয়োজিত কর্মসূচির মধ্য রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, হলের সামনের স্মৃতি ভাস্কর্য স্ফুলিঙ্গে ৮ টায় ও ৯ টায় ড. জোহার মাজার ও তাঁর স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা। বাদ আসর হল মসজিদে কোরআনখানি ও মোনাজাত, সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্জ্বালন এবং মুক্তিযোদ্ধা ভিত্তিক চলচ্চিত্র স্ফুলিঙ্গ প্রদর্শন করা হবে।

লেখক : প্রফেসর ড. একরামূল ইসলাম
প্রাধ্যক্ষ, শহীদ শামসুজ্জোহা হল ও সিন্ডিকেট সদস্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর