বিএনপির ভারসাম্যের রাজনীতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-23 20:52:50

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা ৭ দফা দাবি আদায় করে ১১ দফা লক্ষ্যে পৌছতে চায়। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের মূল শক্তি বিএনপিকে ভারসাম্যের খেলাটা খেলতে হচ্ছে নির্বাচনের আগেই। ৩০০ আসনের জন্য বিএনপির মনোনয়ন কিনেছেন ৪ হাজার ৫৮০ জন। কিন্তু মনোনয়ন পাবেন ৩০০ জন। বাস্তবতা হলো বিএনপি মনোনয়ন দিতে পারবে বড় জোর ২০০ আসনে। শরিকদের জন্য অন্তত ১০০ আসন ছাড়তে হবে তাদের। বিএনপির ভাগ্য ভালো বিকল্পধারা তাদের সঙ্গে আর নেই। থাকলে বিপদ আরো বাড়তো। কারণ জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার শুরুতে বিকল্পধারার মাহি বি চৌধুরী বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে শরিকদের জন্য ১৫০ আসন দাবি করেছিলেন। ক্ষমতায় গেলে যাতে বড় দল ছোট দলগুলোকে ছুড়ে ফেলতে না পারে, সে জন্যই মাহি সে প্রস্তাব রেখেছিলেন, যাতে কেউই এককভাবে সরকার গঠন করার মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়।

মাহি বি চৌধুরীরা ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে ভিড়ে বিএনপির বিপদ কিছুটা কমিয়ে গেছেন বটে, তবে জটিলতা এখনও কাটেনি। বিএনপিকে এখন দারুণ ব্যালেন্স গেম খেলতে হচ্ছে। তাদের একদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, আরেকদিকে পুরোনো ২০ দলীয় জোট। এই দুই জোটের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিএনপির সাফল্যের রহস্য। সার্কাসে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার খেলা দেখেছেন? একবার এদিকে, একবার ওদিকে হেলতে দুলতে দড়ি পার হতে হয়। মনে হয়, এই বুঝি পড়ে গেল। এখন পর্যন্ত ভারসাম্যের খেলাটা ভালোই খেলছে বিএনপি। রোববার থেকে গুলশানে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার নেয়া শুরু হয়েছে। লন্ডন থেকে স্কাইপে সাক্ষতকার নিচ্ছেন তারেক রহমান। কিন্তু এই সাক্ষাতকারে তো জটিলতার শেষ নয়, শুরু মাত্র। আসল জটিলতা শুরু হবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের সাথে আসন বন্টন নিয়ে। সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ার সময় বিএনপির মূল সমস্যা ছিল জামায়াত। কারণ জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া স্বাধীনতাবিরোধী কারো সাথে ঐক্য করতে রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিএনপি কৌশলে এক পাশে জামায়াতকে রেখেই বৃহত্তর ঐক্য গড়তে সক্ষম হয় তারা। এখন তাদের এক হাতে জামায়াত তথা ২০ দল, আরেক হাতে ঐক্যফ্রন্ট। জামায়াতের ভোট আছে, ভাবমূর্তি নাই। আবার ড. কামালদের ভাবমূর্তি আছে, ভোট নাই। কিন্তু বিএনপির ভোট এবং ভাবমূর্তি দুটোই দরকার। তাই তারা কাউকেই ছাড়তে চাইছে না।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা উল্টো ঘটনা ঘটেছে। সাধারণত নির্বাচনী জোটের ক্ষেত্রে বড় দলের সাথে যুক্ত হয় ছোট দলগুলো। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টেই ব্যতিক্রম। বড় দল বিএনপি যোগ দিয়েছে ছোট দলগুলোর সাথে। ঐক্যফ্রন্টের মূল নেতাও বিএনপির কেউ নন, গণফোরামের ড. কামাল হোসেন। বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছেও ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই। রাজনীতিতে তাই আলোচনায়ও ঐক্যফ্রন্ট। তারাই সবকিছুতে গুরুত্ব পাচ্ছে। আর তাতে গুরুত্ব হারিয়েছে বিএনপির বিপদের বন্ধু ২০ দল। অনেকে অভিমান করে দূরে সরে ছিলেন। শেষ মুহূর্তে তাদের সক্রিয় করা হয়েছে। ৯ মাস পর ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে যোগ দিয়েছেন কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতে তিনিই ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন, এই শর্তে অলি সরব হয়েছেন। বিএনপি দারুণ কৌশলে খেলছে। কাগজে কলমে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব ড. কামাল হোসেনের হাতে আর ২০ দলের নেতৃত্ব কর্নেল অলির হাতে। কিন্তু মূল নিয়ন্ত্রণ কিন্তু বিএনপির হাতেই।

ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দল অভিন্ন প্রতীক 'ধানের শীষ'এ নির্বাচনে অংশ নেবে। তার মানে ড. কামাল হোসেনের প্রতীক আর জামায়াত প্রার্থীদের প্রতীক কিন্তু এক ও অভিন্ন থাকবে- ধানের শীষ।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভাবমূর্তিতে বিশাল হলেও বিএনপিকে বাদ দিলে ভোটের মাঠে তাদের গুরুত্ব সামান্যই। গণফোরাম, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ- সবগুলোই ব্যক্তিসর্বস্ব দল। ৫টি দল মিলে পাশ করার মত ব্যক্তি আছেন ১০ জন। কিন্তু বিএনপির কাছে তাদের দাবির তালিকা অনেক লম্বা। মাহমুদুর রহমান মান্না যত বড় নেতাই হোন, বিএনপি কি তাকে বগুড়ার কোনো আসন ছেড়ে দেবে? চট্টগ্রামে চন্দনাইশ কর্নেল অলির এলাকা। আবার গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীও সে আসন থেকেই মনোনয়ন চাইছেন। কর্নেল অলিকে দিলে জেতার সম্ভাবনা বাড়বে। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের মূল দল গণফোরামের কার্যকরী সভাপতিকে মনোনয়ন না দিলে কীভাবে হবে? কামরাঙিরচরে বিএনপির প্রার্থী আমানউল্লাহ আমান। আবার গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুও এই এলাকার মানুষ। কে পাবেন মনোনয়ন? কুলাউড়ায় ২০ দলের মনোনয়ন চান জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)এর নওয়াব আব্বাস। আবার সেখান থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী সুলতান মনসুর। এমন সমস্যা অনেক জায়গাতেই হবে।

ঐক্যফ্রন্টকে আসন ছাড়তে গেলে ২০ দলের ভাগে কম পড়বে। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত জোটসঙ্গীদের কীভাবে মানাবে বিএনপি? অবশ্য ২০ দল জামায়াত ছাড়া আর সব দলই ব্যক্তিসর্বস্ব। তবুও তারা ১০ বছর ধরে অত্যাচার সয়ে, লোভ উপেক্ষা করে বিএনপির সাথে আছে। শেষ মুহূর্তে তাদেরও বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। হিসাবে একটু ভুল হলে দলে, জোটে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে পারে। এই হিসাবটা কত ভালোভাবে করতে পারবে, কত দক্ষতার সাথে ভারসাম্যের খেলাটা শেষ করতে পারবে বিএনপি; তার ওপরই নির্ভর করছে, তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর