ভালোবাসা ও গোলাপের যুদ্ধাক্রান্ত দেশ ইউক্রেন

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 16:54:07

মৌসুমি ভৌমিক তার একটি জনপ্রিয় গানে বলেছেন, 'আমাদের ভালোবাসা এখনও গোলাপে ফোটে।' এই বসন্তে বাস্তব চিত্রটি এমনই হতে পারতো। কিন্তু হলো না। ভালোবাসা মুখথুবড়ে পড়েছে রণাঙ্গনে। কৃষ্ণসাগরের তীরে। যেখানে রুশ আগ্রাসনে রক্তাক্ত ও বিরান ইউক্রেন।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রলম্বিত ও চলমান হানায় মৃত্যু ও দুঃখ যখন প্রকটিত, তখনও এই বসন্তে পৃথিবীর দেশে দেশে, শহরে নগরে, গ্রামে গঞ্জে মানুষ ভালোবাসায় মেতেছে গোলাপে ও ফাগুনে। কিন্তু বসন্ত ঋতুর প্রথম সপ্তাহেই ভালোবাসা স্তব্ধ করে ইউরোপের এসেছে যুদ্ধের রণহুঙ্কার।

বেশ আগে থেকেই রুশ-ইউক্রেন উত্তেজনা চলছিল। আন্তর্জাতিক মহলও সরব ছিল এই সঙ্কটে। গোপনে ও প্রকাশ্যে পক্ষে-বিপক্ষে হচ্ছিল মেরুকরণও। অকস্মাৎ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ভাষণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। তিনদিক থেকে রুশদের প্রবল আক্রমণে শান্তিপূর্ণ ও নিরীহ রাষ্ট্র ইউক্রেন কোণঠাসা। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেই রাজধানী কিয়েভ পতনোন্মুখ।

আগ্রাসী রুশ বাহিনী দখল করেছে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ, স্থাপনা, পারমানবিক কেন্দ্র। দিকবিদিক পালাচ্ছে মানুষ। ইউক্রেনে আটকে থাকা বিদেশিরা জানাচ্ছেন মর্মন্তুদ বিবরণ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া এমন ভয়াল ও বীভৎস বসন্ত আর দেখেনি ইউরোপ।

পারসিক গোলাপ বিশ্বসেরা হলেও ইউরোপে এই ফুল মশহুর। জার্মান কবি রিলকে গোলাপের স্তুতিবাদে ছিলেন মুখর। গোলাপ ভালোবাসার উপহারের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করে। যে লাল গোলাপকে প্রেমের প্রতীক মনে করা হয়, তা এখন রক্তরঞ্জিত। যে গোলাপের গন্ধ মিশে আছে প্রেমে, তা এখন যুদ্ধের ময়দানে বারুদের মতো পুড়ছে।

এই বসন্তে মায়াবী হয়ে ওঠা সম্পর্কের আনাচে-কানাচে গোলাপের বদলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বেনোয়েট ও মারণাস্ত্র। ভালোবেসে কেউ প্রেমিকার মাথায় গুঁজে দেন ফুল, কেউ আবার উপহারের ফুলকে যত্ন করে রেখে দেন গল্পের বইয়ের প্রিয় কোনও পরিচ্ছেদের খাঁজে। তেমন শত সহস্র গোলাপ এখন নিহত হয়ে লুটাচ্ছে ইউক্রেনের পথে-প্রান্তরে।

বসন্তে ও প্রেমের ঋতুতে পাশের প্রিয় মানুষটির জন্য ভালোবেসে ফুল কিনে নিয়ে যায় যে প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা, তারা এখন নিজেরাই মৃতদের দলে। কিংবা জীবন্ত প্রিয়জনের বদলে বেদনার গোলাপ সাজাচ্ছে তার মৃতদেহের নিথর কফিনে। করোনার সমান্তরালে যুদ্ধের এই মৃত্যুগুলো ভালোবাসা ও বসন্তের শরীর ঢেকে দিচ্ছে পাশবিকতার কালো চাদরে।

ইউক্রেন দুটি সৈকত আর অসংখ্য দর্শনীয় স্থানের এক অনিন্দিত দেশ। সেখানে মানুষকে বরণ করা হয় প্রীতি ও পুষ্পের সম্ভাষণে। নির্ভয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা হাতে ফুল নিয়ে উচ্ছ্বাসের পথে হাঁটে। সারা বছরই দেশটিতে 'বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'। সারা বছরই প্রাণোচ্ছল মানুষেরা মেতে থাকে উৎসবের বর্ণাঢ্য আয়োজনে। হাতে গোলাপ, মনে বসন্তের ছোঁয়ায় প্রেম আর পার্বণ হাত ধরাধরি করে চলে সেখানে।

ইউক্রেনবাসী বছর শুরু করে রোজ ডে দিয়ে। এরপর প্রোপোজ ডে, চকোলেট ডে, টেডি ডে, প্রমিস ডে, হাগ ডে, কিস ডে হয়ে আসে বহু প্রতীক্ষিত ভ্যালেন্টাইন্স ডে। টানা এক সপ্তাহের প্রেম পর্ব চলে সেখানে যুগলবন্দী আবহে। ভালোবাসার প্রতিটা অনুভূতিকে আলাদা আলাদা করে সেলিব্রেট করার এমনই বাসন্তিক ফেব্রুয়ারিতে প্রেমের বাহারি সাজ ও আলোকমালা অন্ধকার করে সেখানে চলছে নরকযন্ত্রণা। আগ্রাসান তছনছ করেছে গোলাপ ও ভালোবাসাকে। তবু বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী প্রতিটি মানুষ অকুতোভয়ে নৈতিক সাহসে দাঁড়িয়েছে ভালোবাসা ও গোলাপের যুদ্ধাক্রান্ত দেশ ইউক্রেনের পাশে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর