তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-08-30 05:32:01

আমরা জানি মুখের ভাষা বাদেও রয়েছে শরীরের ভাষা, মনের ভাষা, চোখের ভাষা, ইত্যাদি। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এইসব ভাষা কেউ কেউ বুঝতে পারছেন না বা বোঝার চেষ্টা করছেন না। কেউ কারো ভাষা বুঝতে না পারা বা বোঝার চেষ্টা না করা নিদারুণ কষ্টের। প্রায় দু’বছর ধরে চলা করোনা মহামারির ভাষা বা গতি— প্রকৃতিও বোঝা যাচ্ছে না। নিত্য নতুন ধরন নিয়ে এই ভাইরাসের আক্রমণ কখনও কম আবার কখনও বেশী। কেনো এমন হচ্ছে তা বিশেষজ্ঞসহ আমজনতারাও বুঝতে পারছেন না। আর এই না বোঝার ফলে আমজনতা এখন এই ভাইরাস সম্পর্কে জানা বা বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে। তারা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারীতে অতি সাধারণ মানুষের আর্থিক, সামাজিক, মানসিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বারোটা বাজলেও তাদের ভাষা বোঝার  চেষ্টা কেউ করছে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী প্রয়োজন হয় ― সেসব তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে অতি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠলেও কতৃর্পক্ষ এইসব মানুষের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছেন বলে মনে হয় না।

অতি সাধারণ মানুষও পাড়ার দোকানদার, ভ্যানে করে শাক—সবজি বিক্রেতা ও ফেরিওয়ালা, বাজারের মাছ, মুরগি ব্যবসায়িদের ভাষা বুঝতে পারছেন না। কারণ ব্যবসায়িরা যে ব্যাখ্যাটি প্রদান করেন― অতি সাধারণ মানুষ তার বিন্দু—বিসর্গ জ্ঞানও রাখেন না। কারণ  কেনাকাটা নিয়ে তাদের জ্ঞান আশপাশের হাট—বাজার ও পাড়ার দোকানপাট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা তাদের মাথাতে আসার কথা না। সুতরাং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভাষা বোঝার চেষ্টা তারা জলাঞ্জলি দিয়েছেন।

বিশেজ্ঞরা বলছেন করোনা মহামারিকালে সব বয়সি মানুষের মনোজগতে ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। করোনাপূর্ব যে জীবন আমরা দেখেছি, উপভোগ করেছি―তার সাথে এখন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংক্রমণ রোধে চালু করা বিভিন্ন বিধি—নিষেধের কারণে আমাদের মধ্যে চলে এসেছে এক প্রকার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ। যার ফলে আমরা কেউ কারো ভাষা বুঝে উঠতে পারছি না। স্বামী, স্ত্রীর ভাষা বুঝতে পারছে না। স্ত্রীও স্বামীর ভাষা বুঝতে পারছে না। সন্তান বাবা—মায়ের ভাষা বুঝতে পারছে না। বাবা—মায়েরাও সন্তানের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে বলে মনে হয় না। আত্মীয়—স্বজন, পাড়া—প্রতিবেশী, বন্ধু—বান্ধব  কেউ কারো ভাষা বুঝতে পারছেন না। সুতরাং একে অপরের ভাষা বুঝতে না পেরে বিছিন্নতাবোধের ধারালো থাবা পড়ছে আমাদের সমাজ জীবনে। বাড়ছে নেশার দৌরাত্ব্য ও সামাজিক অবক্ষয়। যার প্রমাণ মাঝে মাঝেই দেখা যায়। যেমন, অনেকেই ফেসবুক লাইভে এসে নিজের জীবনকে শেষ করে দেবার চেষ্টা করছে। আবার অনেকেই পিস্তলের গুলিতে নিজের মাথার খুলি চুরমার করে ফেলছেন। 

গণপরিবহনে দীর্ঘকাল ধরে চলা বিশৃংখলা ঠেকাতে চিৎকার, চেঁচামেচি করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। অবস্থা যে লাউ সেই কদুই রয়ে গেছে। যাত্রীদের ভাষা গণপরিবহনের মালিক, চালক, সুপারভাইজার ও হেলপাররা বুঝতে চেষ্টা করেন না। আবার যাত্রীরাও তাদের ভাষা বোঝেন না। কাজেই উভয় পক্ষই তাদের ভাষা বোঝার চেষ্টা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। হারিয়ে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ। খালি হচ্ছে মা—বাবার কোল। শোকে স্তব্ধ হচ্ছে প্রিয়তমা স্ত্রী, সন্তান, ভাই—বোন, আত্মীয়—স্বজন। পঙ্গু হয়ে জীবনের ভার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে  টগবগে হাজারো তরুণ, যুব ও বৃদ্ধের। পরিবহন সেক্টরের ভাষা বোঝা তাই তারা ছেড়ে দিয়েছেন।

বেকার যুবক—যুবতী বুঝতে পারছে না নিয়োগ কর্তার ভাষা। আবার নিয়োগ কর্তাও তাদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেন না। লক্ষ লক্ষ বেকার তাই চাকুরি পাওয়ার আশা ত্যাগ করে রাজপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। জীবনের ভাষা বোঝা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। ঘুস, দুনীর্তি, মাদক, নারী পাচার, বাল্যবিয়ে, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা, ইত্যাদি বৃদ্ধি পেলেও তা প্রতিরোধ ও কমানোর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কতৃর্পক্ষ তাদের ভাষা বুঝতে পারছেন না। ধনীরা গরীবদের ভাষা বোঝে না; গরীবরাও ধনীদের ভাষা বুঝতে পারে না।

উপাচার্য মহোদয়গণ ছাত্র—ছাত্রীদের ভাষা বুঝতে পারেন না। শিক্ষকরাও ছাত্র—ছাত্রীদের ভাষা বুঝতে পারছেন না। ছাত্র—ছাত্রীরাও উপাচার্য ও শিক্ষকদের ভাষা বুঝতে পারছেন না। ফলে কিছুদিন পরপরই শুরু হচ্ছে বিক্ষোভ, আন্দোলন। তারপর আবার সব চুপচাপ। কারণ এসব করে কোনো লাভ হয়না। কেউ কারো ভাষা বোঝে না। তাই সবাই চুপ হয়ে যান।

হাসপাতাল মালিক ও চিকিৎসকগণ রোগীদের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেন না। অন্যদিকে রোগীরাও চিকিৎসকদের ভাষা বোঝেন না। হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা সম্পির্কত খরচ মেটাতে তাদের যে হিমশিম খেতে হয়; ভিটে—মাটি বিক্রী করে নিঃস্ব হতে হয় সে সম্পর্কে কেউ বোঝার চেষ্টা করেন না। রোগীরাও কাউকে বোঝাতে পারেন না। ফলে তারা চিকিৎসাসেবার ভাষা বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছেন বলে প্রতীয়মাণ হয়।

পত্রিকায় প্রায়শই প্রকাশিত হয় মন্ত্রী ও আমলাদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন। ধরে নেয়া যায় মন্ত্রীরা আমলাদের ভাষা বোঝেন না। অন্যদিকে, আমলারাও মন্ত্রীদের ভাষা বোঝেন না। এমপিদের অবস্থাও সম্ভবত একই। মাঠ পর্যায়ের কোনো কোনো আমলা তাদের কথার নাকি যথাযথ গুরুত্ব দেন না। যা নিয়ে মহান জাতীয় সংসদে কোনো কোনো এমপি  মাঝে মঝেই সরব বক্তব্যের  মাধ্যমে আক্ষেপ করে থাকেন।

জাতীয় রাজনীতির ভাষাও কেউ বুঝতে পারছে না বলে ধারণা। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের চাওয়া—পাওয়ার দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত বলে অনেকেই পত্র—পত্রিকা ও টেলিভিশনে মন্তব্য করে থাকেন। সবকিছুতেই তাদের অবস্থান নেতিবাচক। কোনো কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই বলে তারা ঘোষণা দিয়ে বসে আছে। তাদের ভাষা অনেকেই বুঝতে পারছেন না বলে ধারণা।

অপরদিকে, প্রায়ই পত্রিকায় খবর হয়, ক্ষমতায় থাকা দল তাদের দুঃসময়ের মিত্রদের যথাযথ মূল্যায়ন করছেন না। নিজেদের মিত্রদের ভাষা তারা বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। মিত্ররাও সরকারের ভাষা বুঝতে পারে না বলে অনেকেই মনে করেন। স্থানীয় নেতা— পাতিনেতাদের ভাষাও সাধারণ মানুষ বঝতে পারে না বলে অনেকেই আক্ষেপ করে থাকেন। মুখের ভাষা বাদেও তাদের শরীরের ভাষা বোঝা আরো দুষ্কর বলে আমজনতা তাদের ভাষা বোঝা ছেড়ে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও কেউ কারো ভাষা বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। মহান শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর আয়োজন সম্পন্ন করেছে। ইতিমধ্যেই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠেছে। এই বিষয়ে কেউ কেউ সরব হলেও অনেকেই নিশ্চুপ আছেন। ধরে নেয়া যায় কেউ কারো ভাষা বুঝতে পারছে না।

অনেকেই বলেন লেখকরা কি লেখেন পাঠকরা তা বুঝতে পারেন না। আবার পাঠকরা কি চাই লেখকরাও তা বোঝার চেষ্টা করেন বলে মনে হয় না। সুতরাং লেখক, পাঠক উভয়ই পরস্পরের ভাষা বোঝার আশা ছেড়ে দিয়েছেন বলে অনুমান করা যায়।

পরিশেষে বলা যায়, আমরা কেউই কারো ভাষা বুঝতে পারছি না। প্রায় সর্বক্ষেত্রে, সবার জন্য একে অপরের মুখের ভাষা, মনের ভাষা, শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে সবাই কবি গুরুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন এবং মনে মনে বলছেন “তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জল।

লেখক: গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর