কোনও সঙ্কটে, যুদ্ধে, মারী বা দুর্যোগে সবচেয়ে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজের প্রান্তিক ও দুর্বল অংশ। সে বিবেচনায় নারী ও শিশুরা অকাতরে প্রাণ হারায় দাঙ্গা, হাঙ্গামা, দুর্বিপাক ও যুদ্ধে। বিশ্বের সংঘাত কবলিত এলাকা ও রণাঙ্গনের চিত্রগুলোতে এ সত্য নিত্য উদ্ভাসিত হয়।
আবার এটাও সত্য যে, সমাজের অন্যায়, অপরাধ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে প্রতিবাদমুখর হয় নারীসমাজ। আফগানিস্তানের বিপর্যয়ে কিংবা মিয়ানমারের ফৌজি তাণ্ডবে তা পরিলক্ষিত হয়েছে।
এবার রুশ সেনাদের ইউক্রেন আক্রমণের প্রথম ও প্রাথমিক প্রতিবাদ এসেছে নারীদের পক্ষ থেকে। একজন রুশীয় নারী তার দেশের আগ্রাসী ও যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্টকে তোয়াক্কা না করে পথে দাঁড়িয়েছেন। 'যুদ্ধ নয়, শান্তি', এই স্লোগান এখন বৈশ্বিক নারীর কণ্ঠস্বর। সারা পৃথিবীর যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী মানুষের সমান্তরালে উচ্চকিত নারীর আওয়াজ বিশ্বের মানবিক বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের নারীরা রুশ আগ্রাসনের প্রতিরোধ লড়াইয়ে রয়েছেন সামনের কাতারে। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় জান, মাল, ইজ্জত, আব্রু অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন তারা। ইউক্রেনের নারীশক্তি পরিণত হয়েছেন সে দেশের জাতীয় প্রতিরোধ সংগ্রামের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায়।
যুদ্ধের ময়দানে বা প্রতিরোধের মিছিলেই শুধু নয়, নারীরা যুদ্ধবিরোধী, শান্তির পথ রচনা করেছে ইতিহাসের সঙ্কট ও সংঘাতময় প্রতিটি পর্যায়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নারীদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও লড়াকু মনোভাবের দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতা হয়ে স্থান পেয়েছে শিল্প, সাহিত্য, নন্দনকলা আর চলচ্চিত্রের পরিসরে। সোফিয়া লোরেন অভিনয় 'সানফ্লাওয়ার' ছবি স্থান পেয়েছে ধ্রুপদের তালিকায়। প্রেম ও যুদ্ধের সমীকরণে এক নারীর বেদনাদায়ক আখ্যান অসম্ভব সাফল্যজনক শৈল্পিক শৈলীতে চিত্রিত হয়েছে 'সানফ্লাওয়ার' চলচ্চিত্রে।
'সানফ্লাওয়ার'-এর মতোই সর্বকালের সেরা আরেক ছবি 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'। লুইস মাইলস্টোন পরিচালিত যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্রটি ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায়। এরিক মারিয়া রেমার্ক এর উপন্যাস 'Im Westen nichts Neues' (অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট) অবলম্বনে এই সিনেমাটি নির্মিত হয়ে জগতময় আলোড়ন জাগায়। রেমার্ক (জুন ২২, ১৮৯৮ – সেপ্টেম্বর ২৫, ১৯৭০) একজন জার্মান সাহিত্যিক ও স্বনামধন্য লেখক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন জার্মান সৈনিক ছিলেন এরিক মারিয়া রেমার্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ১৯২৯ সালে রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'। প্রকাশের পর পরই তুমুল জনপ্রিয় হয় উপন্যাসটি এবং পরের বছরই আটলান্টিকের অপর তীরের বিশ্ব চলচ্চিত্রের রাজধানী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডে চলচ্চিত্র রূপে নির্মিত হয়।
মূল ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ হলেও চলচ্চিত্রটিতে চরিত্রায়ন অবশ্য মার্কিন অভিনেতারাই করেছেন। তাই প্রেক্ষিত জার্মান হলেও এই সিনেমার জার্মান যোদ্ধারা ইংরেজিতেই কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে যুদ্ধের প্রতি ঘৃণা আর নারীর অবদান মোটেও ম্লান হয়নি।
সানফ্লাওয়ার'-এর মতোই 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' সিনেমাকে সর্বকালের সেরা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আদর্শ রূপায়ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যুদ্ধের মূলধারাকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করার জন্যই এই সিনেমা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। অ্যামেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট (আইএফআই) তাদের সর্বকালের সেরা ১০০ মার্কিন চলচ্চিত্রের তালিকায় একে ৫৪ নম্বরে স্থান দিয়েছে।
২০০৮ সালে এএফআই ১৫০০ জন সুনির্বাচিত বোদ্ধা চলচ্চিত্রমোদীর ভোটাভুটির ভিত্তিতে সেরা ১০টি মার্কিন ক্লাসিক সিনেমার নাম প্রকাশ করে। এই তালিকায় সর্বকালের সেরা ১০টি মার্কিন এপিক সিনেমার তালিকায় 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' ৭ নম্বরে স্থান পায়। ছবিটিকে ইউনাইটেড স্টেট্স লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস তাদের জাতীয় ফিল্ম রেজিস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। মুক্তির সময়ও এই সিনেমা প্রশংসিত হয়েছিলো। সেরা ছবি এবং সেরা পরিচালকের একাডেমি পুরস্কার অর্জন তার প্রমাণবহ। প্রায়-শতবর্ষ স্পর্শ করার প্রাক্কালেও ছবিটি সমান জনপ্রিয়।
পশ্চিম ভূগোলে যুদ্ধবাজ পুতিনের নেতৃত্বে পরিচালিত রুশ আগ্রাসনে ইউক্রেন আক্রান্তে পটভূমিতে 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' সিনেমাটি আবার নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ এই যে, মানুষ সাধারণত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত লড়াইয়ের নারকীয়তা এবং বিশালতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একটু আড়ালে চলে গেছে । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও নারকীয়তা কিছুটা কম ছিল না । শিল্পবিপ্লবের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল এই যুদ্ধ । আর তাতে ধ্বংসের পাশাপাশি ধস নেমেছিল মানবিকতায়।
সিনেমাটির শুরুতে দেখা যায় যে, এক অধ্যাপক জ্বালাময়ী বক্তৃতার দিয়ে তার ছাত্রদের উৎসাহ দিচ্ছেন সেনাবাহিনীতে যোগদান করার এবং দেশের সঙ্কটে কিছু করার জন্য । ফলে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সমস্ত খাতা-বই সব ছিঁড়ে সেনাবাহিনীতে নাম লেখায় । কিন্তু যুদ্ধে গিয়ে তারা যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, ট্রেঞ্চের ভিতরে দিনের পর দিন লুকিয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে একে একে অনেকেরই মৃত্যু হয়, তখন তারা বুঝতে পারে যে, যুদ্ধের ভিতরে কোনও মানবিকতা কিংবা দেশপ্রেমের রোমান্টিকতা নেই, বরং রয়েছে এক প্রচণ্ড নারকীয়তা । দিনের পর দিন খাদ্যাভাবে ও জলাভাবে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে তারা বুঝতে পারে যে, তারা আসলে রাষ্ট্রনায়কদের হাতের পুতুল। তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে মরবার জন্য । তাদের মা, স্ত্রী, প্রেমিকা, ভগ্নি, কন্যাকে উদ্ধারের বদলে বিপন্ন করা হয়েছে।
যখন এই সত্য আর প্রিয়মুখগুলো যুদ্ধের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে তারা উপলব্ধি করতে পারে, তখন আর ফেরার পথ থাকে না। সিনেমার শেষ হওয়া অবধি তারা একে একে সবাই মারা যায়। আর তাদের মতোই তাদের নিজস্ব নারীরা রণাঙ্গনের তাণ্ডবের বলি হয়।
রুশ যুদ্ধবাজের হাতের পুতুল হয়ে যারা ইউক্রেনে নৃশংসতম হন্তারকের ভূমিকায় লিপ্ত হয়েছে, তারাও একদিন 'সানফ্লাওয়ার' এবং 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'-এর পাত্র-পাত্রীদের মতো যুদ্ধের বিভীষিকা ও শান্তির আবশ্যিকতা উপলব্ধি করবে। কিন্তু তখন হয়ত করার কিছুই থাকবে না। একে একে তারাও মারা পড়বে যুদ্ধের ময়দানে এবং ফ্রান্টের নীরবচারী প্রান্তরে পড়ে থাকবে তাদের নিথর মরদেহ!
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।