চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দশম দিন চলছে আজ। যুদ্ধে সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কার কেমন হয়েছে তা নিয়ে এখনও পরিষ্কার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, দু’পক্ষই সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধে অদ্যাবধি বেশিরভাগ মৃতের সংখ্যা অপ্রমাণিত। যুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে দু’পক্ষই প্রপাগান্ডার আশ্রয় নিতে পারে বলে ধারণা করা যায়। ইউক্রেনের অনুমান মতে যুদ্ধে রাশিয়ার মৃত সৈন্যের সংখ্যা এবং গুলি করে হেলিকপ্টার ধ্বংস করার সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত বলে মনে হতে পারে। রাশিয়ার পক্ষ থেকেও সঠিক কোনও হিসাব এখনও দেয়নি।
তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা আসলে কত? সম্পূর্ণ মিথ্যা না হলেও যুদ্ধে মৃত্যুর পরিসংখ্যান সবসময়ই অনিশ্চিত হয়ে থাকে। নির্ভরযোগ্য এবং বাস্তবিক পরিসংখ্যানটি কখনও কখনও যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই আসে। তারপরেও গণনা প্রায়শই ব্যাপকভাবে এবং পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হতে পারে।
যুদ্ধের শুরুর দিকে যখন রাশিয়ার আক্রমণ চার থেকে পাঁচ দিন গড়িয়েছিলো, তখন ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ বলেছিল ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে আনুমানিক ৫০০০ এরও বেশি রাশিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছে। কতগুলি রাশিয়ান যুদ্ধ কামান এবং হেলিকপ্টার ইউক্রেন ধ্বংস করেছিলো, তার পরিসংখ্যানও তখন প্রচার করা হয়েছিল। গত ২ মার্চ বুধবার, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ান নিহত সৈন্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০০ জনে। তবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সর্বশেষ দাবি অনুযায়ী তারা অন্তত ৯০০০ রাশিয়ান সৈন্য হত্যা ছাড়াও রাশিয়ার ২১৭টি ট্যাংক, ৯০টি আর্টিলারি সিস্টেম, ৩১টি হেলিকপ্টার ও ৩০টি বিমান ধ্বংস করার দাবি করেছে।
দাবিকৃত এই সংখ্যাগুলোর সত্যতা কতটুকু? একটি যুদ্ধ চলাকালে এটি জানা প্রায় অসম্ভব। তবে যুদ্ধের বিভিন্ন ইঙ্গিত এবং এমন কিছু সূত্র রয়েছে যে, মৃত রাশিয়ান সৈন্যের সংখ্যাটিকে সাময়িকভাবে অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয় বা ধরে নেওয়া যেতে পারে। এটা বোধগম্য যে, যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি উপস্থাপনে ইউক্রেনের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যদিও অন্যান্য যুদ্ধের তুলনায় ইউক্রেনের উপস্থাপিত সংখ্যাটি কিছুটা বেশি বা অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয়। গত বুধবার মস্কো দাবি করেছে, ইউক্রেনে এ পর্যন্ত মোট ৪৯৮ জন রুশ সৈন্য মারা গিয়েছে। এমনকি রাশিয়ার সেই দাবিকৃত সংখ্যাটিও ক্রসচেক বা নিরপেক্ষ বলা সম্ভব নয়।
আফগানিস্তানে ২৫০০ জনেরও বেশি আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়েছিলো এবং তা ২০ বছর ধরে। এটা অনস্বীকার্য যে, একই ধরনের অন্যান্য যুদ্ধে সামরিক বাহিনীগুলোর মৃতের সংখ্যা আরও বেশি এবং মারাত্মক হয়েছিল। ১৯৯৯ এবং ২০০৯ সালের মধ্যে চেচনিয়ায় দ্বিতীয় যুদ্ধে অনুমান করা হয় যে, ৩৬০০ জনেরও বেশি রাশিয়ান সৈন্য মারা গিয়েছিল। তবে যুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন অনুমান- এবং রিপোর্টগুলিতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি সংখ্যা বলা হয়েছিলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রায় ১৫০০০-২০০০০ জন রাশিয়ান সৈন্য নিহতের কথাও বলা হয়েছিল এবং বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি বলে অনুমান করা হয়েছিলো।
সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, যুদ্ধে অদ্যাবধি ইউক্রেন কর্তৃক ৬ থেকে ৯ হাজারের অধিক রুশ সৈন্য নিহত বা আহত হওয়ার দাবিটা প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছুটা অতিরঞ্জিত বা বেশি হতে পারে। মার্কিন এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুমানে যুদ্ধ শুরুর সপ্তাহান্তে এই সংখ্যাটি প্রায় ২০০০ এর মত বলে ধরা হচ্ছে। রাশিয়া অবশ্য গত ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বীকার করেছে, ইউক্রেনে তার সেনাবাহিনী যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস অনুসারে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগের মুখপাত্র মেজর জেনারেল ইগর কোনাশেনকভ বলেছেন, সৈন্যরা মৃত ও আহত হয়েছে।
গত ২ মার্চ ইউক্রেনের অনলাইন সংবাদমাধ্যম ’কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ একটি অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করেছে, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে, কিভাবে ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে একটি রাশিয়ান ইউনিট প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মাত্র ১৮ জন রাশিয়ান সৈন্য যুদ্ধ থেকে কিভাবে জীবন নিয়ে পালিয়েছে। গত ২৪ ফেব্রিুয়ারি বৃহস্পতিবার রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে কতজন ইউক্রেনীয় সৈন্য মারা গেছে তাও অনিশ্চিত। তবে ঠিক এই মুহূর্তে অনুমান নির্ভর করে এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যেতে পারে, ইউক্রেনীয় এবং রাশিয়ান দু’পক্ষের ক্ষতির পরিসংখ্যান প্রায় একই হতে পারে। তবে সে ব্যাপারেও জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না।
এ তো গেল সৈন্য ও গোলাবারুদের হিসাব নিকাশ। ইউক্রেনের বেসামরিক জনসাধারণের মৃত্যুর সংখ্যা এবং সম্পত্তি বিনষ্টের পরিমাণ কত? গত সোমবার খারকিভে দশ বা তার বেশি বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার কিয়েভের টিভি টাওয়ারে রাশিয়ার হামলায় পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। জাতিসংঘ গত ১ মার্চ মঙ্গলবার ১৩৬ জন বেসামরিক মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, যার মধ্যে ১৩ জন শিশু এবং আহত হয়েছে প্রায় ৪০০ জনেরও অধিক যার মধ্যে ২৬ জনই শিশু। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ তারপরের দিন দাবি করে, ইউক্রেনের ২০০০ জন বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে।
অন্যান্য এলাকার মধ্যে, দক্ষিণ-পশ্চিম ইউক্রেনের মারিওপোলে গ্রেনেড হামলায় ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ে আহত হয়েছে, যেখানে রাশিয়া বেশ কয়েকদিন ধরে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো। সংবাদ সংস্থা এপির তোলা ভিডিওতে মেয়েটির বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে যাওয়ার চিত্র দেখা যায়। একই সময়ে ৮ লাখেরও বেশি মানুষ ইউক্রেন থেকে পালিয়ে পোল্যান্ডের দিকে গিয়েছে।
পুরো ইউরোপ জুড়ে বর্তমানে ইউক্রেনীয় শরণার্থী ছড়িয়ে পড়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলো যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সব শরণার্থীদের তাদের দেশে জায়গা দেওয়ার জন্য। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপের মুখে থাকা ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য বিশাল সংখ্যক এই শরণার্থী আরও চাপের মুখে ফেলবে। তবে সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই চাপ সামলাতে বদ্ধপরিকর বলে ঘোষণা দিয়েছে।
সাব্বির খান, বিশ্লেষক, কলামিষ্ট ও সাংবাদিক