বাজার পরিস্থিতি: মোহ যদি ভাঙত তাদের!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 22:31:40

করোনার ধাক্কায় টালমাটাল এমনিতেই দেশ, বিশ্ব। বৈশ্বিক এই মহামারিতে নাজেহাল সব শ্রেণিপেশার মানুষ। তবু মানুষ বাঁচতে শিখেছে। খেয়ে, না খেয়েই অনেকটা; ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীরা বিপর্যস্ত, নিম্ন-আয়ের মানুষের কষ্ট কেবল নিজেদেরই। উচ্চবিত্তদের হেরফের হয়নি তেমন একটা। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি শ্রেণিচ্যুত হয়েছে, নিম্নবিত্তরা নিঃস্ব প্রায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেশিরভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে নেমে গেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তে। এনিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণার কথা জানা যায়নি, তবে সাধারণের একজন হিসেবে অপরাপর সাধারণের সঙ্গে মিশলে এর প্রমাণ মেলে।

করোনা থাকাকালে এখন চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। এক লহমায় পুরো বিশ্বের চোখ নিবদ্ধ ওই দিকে। মুহূর্তেই হাওয়া করোনার আলোচনা। করোনাভাইরাসের চেয়েও মহামারি হয়ে দেখা দিয়েছে এই যুদ্ধ-ভাইরাস। তৃতীয় বিশ্ববাসী হলেও ওই যুদ্ধের প্রভাব দেখতে শুরু করেছি। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে। কিন্তু বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই কোন না কোন পক্ষে। চলছে নিষেধাজ্ঞা-নিষেধাজ্ঞা খেলা! বিশ্বায়িত বাণিজ্য ব্যবস্থায় এই নিষেধাজ্ঞা-খেলা থেকে আমরা মুক্ত হচ্ছি কই, কীভাবে? কোন না কোনভাবে এর প্রভাব পড়েছে, পড়ছে এবং এই সংঘাত দীর্ঘায়ত হলে এর প্রভাব পড়বে প্রকটভাবে। যদিও পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে না।’ তবে তিনি এও বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তা, জানতে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের যে বাজার আছে, পশ্চিমা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেখানে আমাদের এক্সপোর্ট মার্কেট, কাপড়, মাছ মাংস, খাবার-দাবার এগুলো যাবেই। এগুলো আটকানোর কথা না। এই যুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব দেখছি না। আরেক বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে কিছু ব্যবসা আছে, খুব বেশি না। তাদের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসা হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তারা ঋণ দিয়েছে। এটি করোনাকালীন বন্ধ হয়নি, এখনো বন্ধ হবে না।’

মন্ত্রী তাৎক্ষণিক প্রভাব না দেখলেও যুদ্ধের প্রভাব এভাবে সরাসরি হয় না, আস্তে-আস্তে পড়তে শুরু করে। ইউরোপীয় দেশগুলো একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে রাশিয়ার ওপর। রাশিয়ার বন্ধু কিংবা রাশিয়ার বিপক্ষে নয় এমন দেশের বিরুদ্ধেও কঠোর হতে সময় কি নেবে তারা? বাংলাদেশের ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান এক্ষেত্রে প্রভাবক হতে পারে। যার ছোট্ট হলেও একটা প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি। জাতিসংঘে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোটদানে বিরত থাকায় পূর্ব-ইউরোপের ছোট্ট দেশ লিথুয়ানিয়া বাংলাদেশে করোনার ভ্যাকসিন দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এমন না যে বাংলাদেশ লিথুয়ানিয়ার কাছ থেকে ভ্যাকসিন চেয়েছে। তবু তারা সদর্পে এমন ঘোষণা দিয়েছে। দেশটি এক্ষেত্রে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করেছে যদিও তবু এটাকে হালকাভাবে দেখার কি সুযোগ আছে আমাদের? কোভ্যাক্সের অধীনে লিথুয়ানিয়া বাংলাদেশকে সাড়ে চার লাখের মতো ফাইজারের ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। স্রেফ রাশিয়ার বিপক্ষে জাতিসংঘে ভোট না দেওয়ায় কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গের পথেই হাঁটেনি লিথুয়ানিয়া, তারা একটি স্বাধীন দেশের মতপ্রকাশেও প্রভাব দেখানোর মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। ভ্যাকসিন বিনিময়ের সঙ্গে যে মানবিকতার যোগ রয়েছে সেটাও তারা অবজ্ঞা করেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে আমাদের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে না- এমনটা শুনতে ভালো দেখালেও বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য গত পাঁচ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য শতকোটি ডলারের বেশি হচ্ছে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে আমরা ইতিবাচক অবস্থানে। ইউক্রেনের সঙ্গে আমাদের বড়ধরনের বাণিজ্য না থাকলেও সেটাও দিনদিন বাড়তির পথে। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার কাল দীর্ঘায়ত হলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এছাড়া, রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের একের পর এক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের বাজারও টালমাটাল। যার প্রভাব আমাদের ওপরও পড়তে বাধ্য।

বিশ্বায়িত বাজার ব্যবস্থা, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের বাইরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় নিত্যপণ্যের বাজারদর সবসময়ই ঊর্ধ্বগতির দিকে ধাবিত হয়। রমজান মাসকে সামনে রেখে এর কয়েক মাস পূর্ব থেকে প্রতিবছরই পণ্যের দর বাড়ে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিবারের মতো এবারও সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতার কারণে নিত্যপণ্যের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যদিও কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে, তবে এটা যে মূল দাম থেকে নির্ধারিত হবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পর সেটার শুল্ক কমিয়ে যে দামে আসতে যাচ্ছে সেটাও স্বাভাবিক বাজার-পরিস্থিতির চাইতে অনেক বেশি। এতে করে ভোক্তাসাধারণের ভোগান্তি কমবে না নিশ্চিত। 

বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ঢাকতে সরকারকে মাথাপিছু আয়ের গল্প বলতে শোনা যায়। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের নিম্ন শব্দটা উহ্য রেখে মধ্যম আয়ের দেশের তথ্যের জানান দিতে হয়। পাশাপাশি অসহায়ের মতো বলতেও শোনা যায় ‘কিছুই করার নেই’ শব্দবন্ধও। এরসঙ্গে সমানতালে একাধিক দায়িত্বশীলের বাস্তবতাবিবর্জিত মন্তব্যও। দেশের প্রতিটি মানুষ আগের চেয়ে ভালো আছে উল্লেখ করে সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় গত ১৩ বছরে সাড়ে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘১৫ বছর আগে সারা দিন কাজ করে একজন শ্রমিকের পক্ষে ৩/৪ কেজি চাল কেনা সম্ভব ছিল না। এখন একজন শ্রমিক সারাদিন কাজ করে ১২ থেকে ২০ কেজি চাল কিনতে পারে। মোটা চাল, মোটা চালের কেজি ৪০-৪১ টাকা। অন্যান্যদের ক্রয়ক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি, অনেক ক্ষেত্রে ৩ গুণের কাছাকাছি বৃদ্ধি পেয়েছে।’ [দ্য ডেইলি স্টার, মার্চ ৮, ২০২২]

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাথাপিছু আয়ের এই গোলকধাঁধা নিয়ে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক বিশেষত বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা ও মানুষের ক্রয় ক্ষমতার দিক বিশ্লেষণ করলে। মাথাপিছু আয় মানে কোনো দেশের পুরো আয়কে দেশটির সব মানুষকে ভাগ করে দেওয়া হলে প্রত্যেকের ভাগে যা পড়ে সেটিই। এই হিসাবে কি মানুষের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা বিশ্লেষণ সম্ভব। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের সকল মানুষের সমান আয় কি সম্ভব বাস্তবে; এর দ্বারা বিবেচনা করা কি সম্ভব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা?

বাস্তবতা হলো মন্ত্রী-আমলারা বাজারে যান না, যাওয়ার সুযোগ কম তাদের। তারা মন্ত্রী হয়েই মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যান ক্রমশ। আমলারা আগে থেকেই অন্য ভুবনে। ফলে তাদের পক্ষে প্রকৃত বাজার-পরিস্থিতি জানা সম্ভব নয়। তাই মন্ত্রী প্রকাশ্যে এভাবে বলতে পারেন—‘একজন শ্রমিক তার দৈনিক আয় দিয়েই ১২ থেকে ২০ কেজি চাল কিনতে পারে’, দেশে কোন ভিখিরি নেই’, এমন দাবিও করতে পারেন তারা। অদ্ভুত এ কল্পরাজ্য যেখানে উপচে পড়ে জগতের সর্বসুখ!

দেশ যেদিকে যাচ্ছে যাক কল্পরাজ্যের বাসিন্দারা সতত সুখে। বাস্তবতায় যদি ফিরত তারা, মোহ যদি ভাঙত তাদের; আমাদেরকে সে অপেক্ষায় থাকতেই হচ্ছে!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলামলেখক, ইমেইল: kabiraahmed007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর