শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির গড়মিল!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

কণা ইসলাম, অতিথি লেখক | 2023-09-01 14:35:04

বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ ভাগ বলে দাবি করা হয়। শিক্ষার হার বাড়ছে বটে। তবে নানা হিসাব ও পরিসংখ্যানের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশী মানুষ এখনো পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুরা বেশি।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির গড়মিল বাংলাদেশে খুবই বেশি। শিক্ষা বাড়লেও পুষ্টিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে না। এমনকি, অর্থনৈতিকভাবেও আমরা অনেক অগ্রসর হওয়ার পরেও স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিক থেকে বিপদে আছি।

দেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ লাখ শিশু জন্ম গ্রহণ করে। তার মধ্যে শতকরা ৩৫ থেকে ৫০ ভাগ শিশু কম ওজনের হয়ে থাকে। এর অন্যতম  কারণ মানুষের সচেতনতার অভাব। মাতৃত্ব ও গর্ভকালে মৃত্যুর হারও কম নয়।

শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য, সমাজ, সংসার ইত্যাদি সকল বিষয়ে  নিজেকে সচেতন করে গড়ে তোলা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের প্রথম দায়িত্ব নিজে সচেতন হওয়া এবং তার পরিবারকে সমাজের কুসংস্কার, কুস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতার শিক্ষা দান করা।

এখন বাংলাদেশের বেশীর ভাগ পরিবারেই ২/১ জন করে শিক্ষিত সদস্য আছে। খুব বেশী দূরে যাবার দরকার নেই, তাদের শিক্ষার আলোতে যদি তার পরিবারের প্রত্যেকেই অসচেতনতার অন্ধকার থেকে  বেরিয়ে আসে তবেই তাদের শিক্ষা সার্থক। যে কোনও জাতিকে উন্নত জাতি হিসাবে গড়ে তুলতে সবার আগে সুশিক্ষায় শিক্ষিত পরিবার দরকার। দরকার স্বাস্থ্য ও প্পুষ্টি সচেতন হওয়া।

একথা সবারই জানা, শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায়, অনেক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই পরিবারকে স্বাস্থ্য সচেতন করা দূরের কথা নিজেরাই নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক উদাসীন। এই উদাসীনতার ফলে পুষ্টিহীনতা জনিত বিভিন্ন রোগ তাদের নিত্যসঙ্গী।

বাংলাদেশের খাদ্য ভাণ্ডার ভিটামিনযুক্ত শাকশব্জি, ফলমূলে ভরপুর। স্বল্প আয়েও মানুষ হাতের কাছের খাবার থেকে সকল প্রকার ভিটামিনের নির্যাস গ্রহন করতে পারে। বাদাম থেকে শুরু করে কাঁচা মরিচ, বড়ই, আমড়া, পেয়ারা, পেঁপে, কলা, আমলকি, জাম্বুরা, লেবু, বেল ইত্যাদি সবই ভিটামিন সমৃদ্ধ পুষ্টিগুণে ভরপুর।

আরও কত কি বাংলাদেশে পাওয়া যায়, তার খবর কে রাখে! এমন পুষ্টিগুণে ভরপুর শাকশব্জি, ফলমূল পৃথিবীর ‌অনেক উন্নত দেশেও নেই। বাজারে, দোকানে, শহরের রাস্তায়, ফেরিওয়ালার মাথায়  সবখানে নানান রকম শাক-শব্জি, ফলমূলের সমাহার। তা সত্বেও ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ এবং রক্তস্বল্পতা জনিত রোগ অনেকের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়।

এর একমাত্র কারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব। যে কোনও মানুষ নিজেই যদি নিজের খাদ্যাভ্যাসে সচেতন না হয় তাহলে অন্য কারো দ্বারা তা কখনও সম্ভব নয়। নিজের খাদ্যাভ্যাসে নিজেকেই সচেতন হতে হয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে তা লক্ষ্য করতে পারি। যেমন কয়েকজন সদস্যের একটি পরিবারের মধ্যে যার আগ্রহ শুধু বড় বড় মাছ-মাংসের প্রতি তাকে তেমন খাবারই গ্রহণ করতে বেশী দেখা যায়। এক্ষেত্রে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা অনেক কম। আবার সেই পরিবারেরই স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিটিকে দেখা যায় শাক-শব্জি, ফল-মূল বেশী গ্রহণ করতে। এখানে ভারসাম্য নেই। পারিবারিক খাবারে ভারসাম্য ও সুষম পুষ্টির সমাহার আনতে হবে।

এক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকের দায়িত্ব শিশু অবস্থা থেকেই প্রতিটি সন্তানকে প্রত্যেক বেলার খাবারের মধ্যে সমানভাবে সুষম খাবার গ্রহণের শিক্ষা দেওয়া। তাহলে ছোটকাল থেকেই তারা এই অভ্যাসে অভ্যস্ত এবং সুস্থ্য দেহের অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে সক্ষম হবে।এখন কৃষিতে পুরো বাংলাদেশ বেশ উন্নত। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্যের সরবরাহও প্রচুর। মানুষ সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও স্বাস্থ্য সচেতন হলে স্বল্প আয়েও ভিটামিন সমৃদ্ধ শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি খাবার অল্প মূল্যে সংগ্রহ করতে সক্ষম। কিন্তু কজন তা করে?

আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হলো, এখনও শিক্ষিত নারীদের বেলায় অহরহ ঘটছে গর্ভকালীন নানা দুর্ঘটনা। যা অত্যন্ত দুঃখ জনক। শুধুমাত্র নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীনতা এবং সচেতনতার অভাবে এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। অথচ প্রত্যেকেই নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হলে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে ভিটামিনের অভাব জনিত রোগ ও রক্ত স্বল্পতা জনিত রোগ দূর হবে।

দেশের শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত নারীদের বেশীর ভাগই সন্তান ধারন থেকে শুরু করে সন্তান জন্মদানের পরবর্তী পুরো সময়টাতে ভিটামিনের ঘটিত জনিত সমস্যা ও রক্ত স্বল্পতা জনিত সমস্যায় ভোগে। এমনকি এইসব সমস্যার কারণে অনেক সময় অনেকের অকাল মৃত্যুও ঘটে। একজন অল্প শিক্ষিত নারীর এমন অজ্ঞতা মেনে নেওয়া গেলেও একজন উচ্চ শিক্ষিত কোনও নারীর গর্ভ ধারনের আগে ও পরে অপুষ্টি জনিত জটিলতা এবং একটি অপুষ্ট শিশুর জন্মদানের মত এমন অজ্ঞতা মানা যায় না।

অতএব, সুশিক্ষার পাশাপাশি নিজে সচেতন হওয়া এবং পরিবারের সকলকে সচেতন করে গড়ে তুলতে পারাটাই প্রকৃত শিক্ষার সার্থকতা। স্বাস্থ্য,  পুষ্টি, খাদ্যাভাস ও জীবনাচরণে শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে পারাই সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। এতে রোগ আসার আগেই তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

কণা ইসলাম: জার্মানি প্রবাসী শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর