নির্বাচন : প্রতাপ ও জনকল্যাণ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-11 07:56:04

এক.

নির্বাচনী হাওয়া শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। অনেক দ্বিধা-সংশয়-সন্দেহ আছে বটে তবে বাংলাদেশ এখন নির্বাচনী পথেই হাঁটছে। আশা করা যাচ্ছে খুব বড় ব্যতয় না ঘটলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল এবং নিবন্ধিত দল সমূহের নেতৃত্বে গঠিত জোটের আওতায় অনেক অনিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের দিকে এখন বাংলাদেশ। অনেক সংশয়, যদি, কিন্তু আছে তবুও বাংলাদেশের রাজনীতি এখন নির্বাচনমুখী।

নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার এবং তাদের মনোনীতি নির্বাচন কমিশনের অধীনেই এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যা দৃশ্যমান হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন মূলত নৌকা ও ধানের শীষের প্রতীকের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপ পাবে। এই দুই প্রতীক নির্ভর দুই দলকে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক মেরুকরণও চলছে।

দুই.

অবশেষে কেন বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের পথে হাঁটছে? নির্বাচন ছাড়া কি বিকল্প কোনো পথ ছিল? না, ছিল না। শুধু সাংবিধানিক ধারবাহিকতার কারণেই একটা যেনতেন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কেননা, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক যাত্রাপথে যে কালো তিলক লাগিয়ে দিয়েছে, তা আর খুব বেশিদিন বহন করার সামর্থ্য নেই এখানকার রাজনীতির। প্রায় বিনা ভোটে শ’য়ে শ’য়ে সংসদ সদস্য তৈরি করা সংসদের ভার বহন করা এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও নির্ভার নয়। তাই একটা প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন খুব জরুরি। সেই তাগিদটা শাসক দল যেমন অনুভব করেছে, ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দলও তেমনিভাবে বুঝেছে। যদিও ছাড়টা বেশি দিতে হচ্ছে বিএনপিকেই। নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নেই, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দেখা নেই, খালেদা জিয়ার মুক্তি নেই-তবুও বিএনপি জোরেসোরেই নির্বাচনে নামছে। এতো ছাড় দিয়ে, দলের ভেতরে থাকা কট্টরপন্থীদের দাবিয়ে রেখে বিএনপির এই নির্বাচনমুখিনতা কেন? সাদা কথায় বিএনপির উত্তর হচ্ছে, নির্বাচনকেই তারা আন্দোলনের পথ বা উপায় ভাবছে’।

তাহলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে নির্বাচনে অংশ না নেয়া কি বিএনপির জন্য ভুল ছিল? তখন নির্বাচনকে আন্দোলনের পথ ভাবলে কী হোত? নির্বাচনের বদলে, নির্বাচন প্রতিরোধের সহিংস পথে নামতে হলো কেন তখন বিএনপিকে? বিএনপি, রাজনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের আত্মবিশ্লেষণ আজও করেনি। বলা চলে সেই অবকাশও পায়নি বিএনপি। কেননা রাজনীতির ভুল বা ক্ষমতাকালীন রাজনীতির ফলভোগ করতেই তার দিন কেটেছে। গত ১২ বছরে শক্তিমান প্রতিপক্ষের চাপের মুখে এতো দৌড়তে হয়েছে যে, নিজের অতীত কর্ম আর কর্মফলের বিশ্লেষণের কোনো সুযোগই পায়নি বিএনপি।

কাজেই আজ যখন বিএনপি বলছে, নির্বাচনকে তারা আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে সেটা তখন কেবল, বাহিরের কথা, অন্তরের কথা নয়। অন্তরের কথাটা ভীন্ন। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের দুঃসহ বর্তমান কাটানোর সামর্থ্য বিএনপি দেখাতে পারেনি। ফলে, নির্বাচনের মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে পাখা মেলবার একটা নূন্যতম স্পেস খুঁজছে বিএনপি। আপাতত সেই সুযোগকেই সম্ভাবনা হিসেবে দেখে জোরেসোরে নির্বাচনে আসছে বিএনপি। আমরা ব্যক্তি মানুষের কর্মফলের কথা বলি। রাজনৈতিক দলগুলোকেও একইরকম কর্মফলের পথেই হাঁটতে হয়। বিএনপি এখন সেই কর্মফলের পথে হাঁটছে। ফলে এই নির্বাচনে আসা ছাড়া তাদের স্বাভাবিক অন্যকোনো পথ ছিল না।

তিন.

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শেখ হাসিনা বলেছেন, এবারের নির্বাচন খুব কঠিন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। ১৪ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার গণভবনে আওয়ামী লীগের মনোয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা জানান, অনেক জেষ্ঠ্য নেতাও বাদ যেতে পারেন। এতে কিছু করার নেই। এটা মেনে নিতেই হবে। একটা আসন হারিয়ে দিই, অন্যগুলোতে জিতবেই এমন করবেন না কেউ। এটা করলে দেখা যাবে ৩০০ আসনে দল হেরে গেছে। ১৯৯১ সালের মতো গা ভাসিয়ে দেয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, দল হেরে গেলে কারও পিঠের চামড়া থাকবে না।’

এই ভয় আ’লীগের আছে। আবার তাদের ভরসাও আছে উন্নয়নতত্বে। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগকেই সরকারে রাখতে হবে এই প্রচারণার ওপরও ভর করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগসহ তাদের মিত্রদের দাবি, ‘এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শেখ হাসিনার সরকার আবার দরকার’।

শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়নতত্ত্ব, মহাজোটের অপরাপর শরীকদের আবার ক্ষমতায় আসার ব্যাপারটাকে অনিবার্য করে তুলতে চেয়েছে। অন্যদিকে গত দশ বছরে আওয়ামী লীগের টানা শাসন অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও নানা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তারা শেখ হাসিনার আবার ক্ষমতায় আসাকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য সুখকর হবে হলে ভাবতে পারছে না। সেই চ্যালেঞ্জও আছে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জন্য। এসব বৈরিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়েই নিজেদের সরকারের অধীনে এবারের নির্বাচনে নামছে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের মহাজোট।

চার.

গত একদশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন, রুপান্তর ঘটেছে প্রকাশ্যে ও অন্তরালে। একটা পোলারাইজেশন প্রকাশ্য সব কারণ দেখিয়ে। আরেকটা পোলারাইজেশন ঘটেছে মানুষের অন্তর্জগতে। স্বাধীনতার চেতনা, ধর্মীয় জঙ্গিবাদের মোকাবিলা ইত্যকার সব প্রকাশ্য কারণে সরকারের মহাজোটের শরীকদের বড় অংশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে স্বস্তিবোধ করছে। অন্যদিকে অপ্রকাশ্য কারণে রাজনীতির ভেতরে যে পোলারাইজেশন ঘটেছে তার ফল দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের টানা দশ বছরের শাসন তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ওপর যে চাপ তৈরি করেছে তা তাদের নিজেদের অস্তিত্বকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষা দিতে নতুন জোটবন্ধনে মিলিত করেছে। তারই প্রকাশ ঘটেছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তৈরির মধ্য দিয়ে।

আবার রাজনীতিতে বিশেষ করে ভোটের হিসেব-নিকেশ সুবিধাবাদের উত্থান ঘটায়। বড় দলগুলোর দরকার হয় ছোট ছোট দলগুলোর ভোটের সমর্থন। ছোট দলগুলোও নীতি ও আদর্শের চাইতে গুরুত্ব দেয় সাময়িক সুবিধা প্রাপ্তির দিকে।

এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় নেতানির্ভর ছোট ডান ও মধ্যপন্থী দলগুলো। ইসলামি দলগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাজনীতিতে কৌশলগত কারণেই নিকটসময়ের শত্রু, অতীত দিনের প্রতিপক্ষ, শত্রুর শত্রু তাই মিত্র হয়ে ওঠে। এটা বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতির এক রুপান্তরঘন চিহ্ন। একাদশ সংসদ নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারও তাই দুই বৃহৎ জোটের সাথে এরকম খুচরো দলগুলোর নীতিহীন-আদর্শবিহীন নির্বাচনী ঐক্য দেখা দেবে। এসবের বাইরে বড় প্রভাব ফেলার সামর্থ্য রাখা এইচ. এম. এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি মহাজোটের সাথে থাকলেও সেটাই শেষকথা নয়। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট শেখ হাসিনার কাছে বেশি কদর পেলে এইচ. এম. এরশাদ শেষ পর্যন্ত কি করে বলা মুশকিল। তাই নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে নানান চমক ।

পাঁচ.

এবারের নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হবে, কিংবা কতটা পক্ষপাতহীন হবে, ভোটাররা কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও নির্ভয়ে ভোট দিতে যেতে পারবে সেটা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলোয়াড়দের ক্রিয়াকলাপ এবং আমাদের নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে কী রকম নির্বাচন চায়, আর ভারত তাতে কতটা সহমত বা ভীন্নমত পোষণ করে সেটাও এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বরাবরের মতোই প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা, বৃটেন, ইইউ, ভারতসহ অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রদূতদের যে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে, তাতেই বোঝা যায় আমরা বিশ্বায়ন দ্বারা কতটা প্রভাবিত। এখন এই যে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক নড়াচড়া কতটা দেশের জনগণের ভাবনাকে ধারণ করবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। অন্য প্রশ্নটা হচ্ছে, নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করে বর্তমানের যাত্রাকে আমরা কতটা ভবিষ্যতমুখী করবো।

আমরা যদি একটা ভাল নির্বাচন না করি, ভাল সরকার গঠন না করি, সুশাসন ও গণতন্ত্র উপহার দিতে না পারি, তবে কোনো অর্জনই টেকসই হবে না। ক্ষমতার প্রতাপ যদি জনকল্যাণকে অস্বীকার করতেই থাকে তবে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা দলের হয়তো উন্নয়ন হবে, দেশের জনগণের তাতে মঙ্গল হবে না। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাটা স্মরণ করেই লেখাটার ইতি টানতে চাই, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘প্রতাপের মধ্যে পূর্ণতা নেই, প্রেমের মধ্যেই পূর্ণতা।’

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর