বিশ্ব সুখ দিবস: সঙ্কুলে সুখের বার্তা!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 00:32:14

২০ মার্চ (রোববার) 'বিশ্ব সুখ দিবস'কে সামনে রেখে প্রকাশিত World Happiness Report 2022 (WHR)-এর পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য এখন সকলের হাতে হাতে। সুখী-অসুখী সবাই জেনে গেছেন বিশ্বে কোন রাষ্ট্র সবচেয়ে সুখী আর কোনটি তালিকার সর্বনিম্নে।

সুখী রাষ্ট্রের তালিকা করার কাজটি খুব সহজ ছিল না। প্রলয়ঙ্করী বৈশ্বিক মহামারি করোনার থাবা আর যুদ্ধের ত্রাসের মধ্যে সুখী দেশের তালিকা তৈরি করা বেশ কঠিন কাজ। করোনায় প্রায় ৪৭ কোটি আক্রান্ত মানুষ এবং প্রায় ৬১ লক্ষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা সংঘাতের রক্তাক্ত রণাঙ্গনের অসংখ্য আহত, নিহত, বাস্তুচ্যুত মানুষের আহাজারির মধ্যেও প্রণীত হয়েছে সুখী দেশের তালিকা, যার আনুষ্ঠানিক নাম World Happiness Report (WHR)। এমনকি, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে বিশ্ব যখন সুখ বিষয়ক আলোচনায় মগ্ন, তখন চলমান করোনার চতুর্থ ঢেউ-এর আসন্ন পদধ্বনি আরও মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞগণ। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন BA-2 ভ্যারিয়েন্ট হু হু করে ছড়িয়ে বৃদ্ধি করতে পারে ভয়াবহ সংক্রমণ, যা থেকে নিরাপদে নেই বিশ্ববাসী।

তবে, বিদ্যমান সঙ্কুলকালে সুখের বার্তা'র মতো যুদ্ধ এবং মহামারীর এই ঘোরতর অস্থির, বিপদজনক ও  অন্ধকার পরিস্থিতিতে  উজ্জ্বল আলোর কথা জানিয়েছে World Happiness Report 2022 (WHR)। আরও সুখবর এটাই যে, উক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় সাত ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ ১৫৩টি দেশের মধ্যে আছে তালিকার ৯৪ নম্বরে। আগের বছরে প্রণীত পূর্ববর্তী রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০১তম।

জাতিসংঘের এই ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে পরপর পাঁচ বছর বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের শীর্ষ অবস্থানে আসন গেড়ে আছে ফিনল্যান্ড। পর পরেই রয়েছে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। সুখী দেশের তালিকায় আমেরিকার স্থান ১৬ নম্বরে। ব্রিটেন ১৭ নম্বরে রয়েছে।

আমেরিকা ও ব্রিটেনের চেয়েও নিচে ফ্রান্স (২১)। তবে জার্মানির স্থান ১৪ নম্বরে। ব্রাজিলের স্থান ৩৮-এ। বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের স্থান এই তালিকায় রয়েছে ৯৮ নম্বরে। ইউক্রেনে সেনা অভিযান চালানো রাশিয়ার স্থান তালিকায় ৮০ নম্বরে। প্রসঙ্গত, ইউক্রেনে হামলার কারণে পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়ায় নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং এ পদক্ষেপের জন্য তারা নারাজ বা অসুখী।

আর দাঙ্গা ও সংঘাত কবলিত আফগানিস্তান তালিকার সবচেয়ে শেষে স্থান পেয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, সুখের ক্ষেত্রে সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া, এই তিনদেশের অর্জন খুব বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। পক্ষান্তরে,  সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে লেবানন, ভেনিজুয়েলা এবং আফগানিস্তানে। করোনা মহামারি ছাড়াও সুখের দিক থেকে কিছু কিছু দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো সন্ত্রাস, সংঘাত, আত্মকলহ ও নিরাপত্তার সঙ্কট থেকে উদ্ভূত যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা।

দক্ষিণ এশিয়ার নিরিখে এ বারও ভারতের উপরে রয়েছে পাকিস্তান। তবে শুধু পাকিস্তানই নয়, বাংলাদেশ, চীন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা-সহ প্রায় সব প্রতিবেশী দেশই ভারতের উপরে রয়েছে। তালিকায় ২১ ধাপ উপরে উঠেছে চীন। গত বারের তালিকায় চীন ছিল ৯৩ নম্বরে। নয়া তালিকায় চীনের ঠাঁই ৭২-এ। তালিকায় শ্রীলঙ্কা রয়েছে ১২৭ নম্বরে।

২০২২ সালের রিপোর্টি অন্যান্য বছরের মতো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রণীত হয়নি। হয়েছে চলমান বৈশ্বিক মহামারিকালে, যে মহামারি কেবল মৃত্যু, আক্রান্ত, বেদনা এবং যন্ত্রণাই এনে দেয়নি, মানবতামুখী ঐক্য, সামাজিক সমর্থন এবং দানশীলতারও বৃদ্ধি করেছে। বিশ্ববাসী যখন রোগ এবং যুদ্ধের সাথে লড়াই করছে, তখন সুখের সার্বজনীন আকাঙ্ক্ষায় চলমান সঙ্কটকালে মানবিক প্রয়োজনে একে অপরের সমর্থনে এগিয়ে আসার বিষয়গুলো ছিল মানবতার ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রসঙ্গত, এ বছর ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের ১০তম বার্ষিকী সম্পন্ন হয়েছে। ফলে অতীতের মতো এবারও বিশ্বব্যাপী ১৫৩টি দেশে লোকেরা কীভাবে তাদের নিজের জীবনকে মূল্যায়ন করে, তা রিপোর্ট করতে সারা দুনিয়ায় সমীক্ষা বা জরিপ গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে ডেটা বা তথ্য আহরণ করা হয়েছে৷ এতে মৌলিক যে সত্যটি গবেষণার মাধ্যমে প্রতিভাত হয়েছে যে, যুদ্ধ, সন্ত্রাস, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, অশান্তি হয়, বরং মানুষের মধ্যে সুখের আগ্রহই সর্বজনীন এবং  বিশ্বজনীন। 

ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রথম প্রকাশিত হওয়ার সময় বিশ্ব সুখের প্রতিবেদনটিকে দুটি মূল ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো হলো:

১. সুখ মূল্যায়ন বা মতামত বা সমীক্ষার মাধ্যমে পরিমাপযোগ্য করা; এবং

২. সুখের মূল নির্ধারকগুলো আনুমানিক বা কাল্পনিক নয়, বরং চিহ্নিত বা শনাক্তযোগ্য করা।

এ দুটি মানদণ্ডের মাধ্যমে গবেষণা কাঠামোটি ব্যক্তির মাধ্যমে বিশ্বের দেশগুলোর সামগ্রিক জীবন-মান ও জীবন-প্রবাহে 'সুখ' নামক প্রপঞ্চকে মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা করে। বলা বাহুল্য, এ প্রতিবেদনের তথ্যাবলী প্রকারান্তরে বিশ্বের দেশগুলোকে সুখী মানবসম্পদ,  সমাজ, পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা অর্জনের লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ণে ও পদক্ষেপ গ্রহণে বিশেষভাবে সাহায্য করে ও পথ দেখায়।

উল্লেখ্য, এক দশক আগে, সারা বিশ্বের সরকারগুলো বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন এজেন্ডার কেন্দ্রে 'সুখ' নামক ধারণাকে রাখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আগ্রহী না হলেও প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে তাদের আগ্রহ ও  ইচ্ছা বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে।  বিশ্ব সুখের প্রতিবেদনের ফলে বিশ্বব্যাপী মানবিক সুখের মাধ্যমে বৃহত্তর কল্যাণের পথ খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বৈশ্বিক সংকল্প বৃদ্ধি পেয়েছে।

যদিও চলমান মহামারি এবং যুদ্ধের কারণে ব্যক্তিগত সুখ, সামাজিক শান্তি ও মানবিক নিরাপত্তা ভয়ানক হুমকির সম্মুখীন, তথাপি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায়, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা তীব্রতর হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে প্রচেষ্টাও বৃহত্তর অবয়ব পাচ্ছে এবং অধিকতর শক্তি সঞ্চয় করে গতিশীল হচ্ছে। 

ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট চালু হওয়ার পর থেকে সুখ এবং জীবনের সন্তুষ্টি যথাযথভাবে উপলব্ধি ও পরিমাপের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। 'গ্যালাপ ওয়ার্ল্ড পোলে' উপলব্ধ ডেটা দ্বারা তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া, প্রতি বছরই ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের আকার ও পরিধি বাড়াছে এবং বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশকে বছরের পর বছর জরিপের মাধ্যমে কভার করায় পনের বছরের ডেটার প্রাপ্যতা এবং অনন্য স্টক তৈরি হয়েছে।

শুধু তাই নয়, ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে বিবেচনা করা ডেটা'র মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ কীভাবে তাদের নিজেদের সুখকে মূল্যায়ন করে তার একটি স্ন্যাপশট পাওয়া যাচ্ছে। তদুপরি, সুস্থতার বিজ্ঞান বিষয়ক চর্চায় সাম্প্রতিক বাস্তবতার গভীর অন্তর্দৃষ্টিও তৈরি করছে এসব ডেটা। মানুষের অবস্থা বোঝার জন্য এবং কীভাবে মানুষ, সম্প্রদায় এবং দেশগুলোকে সুখী জীবনের দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করা যায়,  তা বোঝার জন্যে এসব তথ্য অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী।

বিগত দশ বছরের মূল্যায়নে আরও দেখা গেছে যে, বছরের পর বছর ধরে বিশ্ব সুখের প্রতিবেদনের তথ্যে সুখের প্রতি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পারস্পরিক উদারতা, মানবিক সততা, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ক্রমশই প্রাধান্য লাভ করেছে।  এতে বিশ্ব নেতাদের জন্য রয়েছে সতর্কবাণী এবং সতর্কবার্তা। আর তা হলো,  হওয়া উচিত।  রাজনীতিকে পরিচালিত করা উচিত ক্ষমতা জন্য নয়, জনগণের কল্যাণের জন্য।

প্রসঙ্গত, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সরকারের উপর আস্থা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশার মতো মাপকাঠিও মাথায় রাখা হয়েছে এই রিপোর্ট তৈরির সময়। এসব মাপকাঠিতে অনেক দেশের মান যে আশানুরূপ নয়, তা স্পষ্ট। পৃথিবীর মোট ১৪৬টি দেশ থেকে তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রণয়নকালে জাতিসংঘের ‘সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক’ বিভিন্ন দেশের মানুষকে ফোন করে নানাবিধ প্রশ্ন করেছে। জানতে চাওয়া হয়, তারা সুখী কি না বা কেন সুখী ইত্যাদি। রিপোর্ট তৈরির সময় নজরে রাখা হয় দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার, মানুষের গড় আয়ু, সামাজিক সহায়তা, কাজ করার স্বাধীনতা, দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোও।

প্রতিবেদন প্রণয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অক্সফোর্ডের ‘ওয়েলবিইং রিসার্চ সেন্টার’, ‘সেন্টার ফর সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট’, ‘ভ্যাঙ্কুভার স্কুল অব ইকোনমিক্স’। ফলে মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য গবেষণার মাধ্যমে প্রণীত এ রিপোর্টের সুখী দেশের যে চিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে, তা সকলের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। অতএব, এ রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো নিজের দেশ ও মানুষকে সুখী তালিকায় এগিয়ে নিতে পারলেই তা হবে সকলের জন্য মঙ্গলময় এবং বৈশ্বিক সঙ্কুলকালে সুখের বার্তা স্বরূপ।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর