অবজ্ঞা ও আতঙ্কের সন্ধিক্ষণে মহামারি!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 23:41:48

'মুখে মাস্ক নেই কেন?'

স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব ড্যামকেয়ার ভঙ্গিমায় অবজ্ঞাকারী খোলামুখের লোকজন উল্টা প্রশ্ন করেন, 'করোনা আছে নাকি যে মাস্ক পরিধান করবো?'

জনমানুষের মধ্যে এখন করোনাভাইরাস সম্পর্কে এমনই মনোভাব। সবাই যেন নিশ্চিত যে, করোনা আর নেই। অতএব, মাস্কের ব্যবহারেরও কোনও প্রয়োজন নেই।

পথেঘাটে, হাট-বাজারে, কোলাহল ও জনসমাগমের স্থানগুলোতে তাকালে দেখা যায়, অতি নগণ্য সংখ্যক মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন।

কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও গবেষকরা বলছেন, কোভিডের টিকা এবং ওষুধের কল্যাণে সামনের দিনগুলোতে মহামারির 'অতিরিক্ত মৃত্যু' ও 'ব্যাপক আক্রান্ত' কমলেও বৈশ্বিক মহামারি এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি এবং সামনের দিনগুলোতে ভাইরাসের নতুন কোনও বিপজ্জনক রূপ আবির্ভূত হতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে টিকাকরণ, স্বাস্থ্যবিধি পালন ও নমুনা পরীক্ষা কমে যাওয়ার কারণে বড় ধরনের সংকটও দেখা দিতে পারে।

নিউইয়র্ক টাইমস মঙ্গলবার (২২ মার্চ) এমনই সতর্কতা জানিয়ে বলেছে, আরেকটি কোভিডের যে ধাক্কা আসছে, তা সামলাতে আমরা প্রস্তুত আছি? আমরা গোলাপি কাঁচের চশমা দিয়ে সব দেখছি বাস্তবের প্রকৃত চিত্র অবলোকনের বদলে। (Another Covid Surge May Be Coming. Are We Ready for It? We’ve been wearing rose-colored glasses instead of correcting our vision.)

এদিকে রয়টার্স মহামারি সংক্রান্ত সর্বশেষ পর্যালোচনায় জানিয়েছে, কয়েক মাস ধরে সংক্রমণের হার কমে আসার পর গত সপ্তাহ থেকে বিশ্বজুড়ে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে চীনের জিলিন প্রদেশে সংক্রমণ রোধে লকডাউন জারির ঘটনাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-র পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে।

ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, সংক্রমণের হার বাড়ার পেছনে উচ্চ সংক্রমণশীল ওমিক্রন ধরন এবং এর বিএ.২ উপধরনটির ভূমিকা আছে। এছাড়া জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক মেলামেশার বিভিন্ন বিধিনিষেধ শিথিলের কারণেও আক্রান্ত বাড়ছে।

ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস সাংবাদিকদের বলেন, 'কিছু দেশে নমুনা পরীক্ষা কমিয়ে দেওয়ার পরেও সংক্রমণের হার বাড়ছে, যার অর্থ হচ্ছে আমরা আসলে একটি হিমবাহের চূড়াটুকুই দেখতে পাচ্ছি।' সংস্থার কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, কিছু দেশে টিকাদানের হারও কম, যার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’ যুক্ত হয়েছে।

ডব্লিউএইচওর হিসাবে, অনেকদিন স্তিমিত থাকার পর বিশ্বজুড়ে মার্চের ৭ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে নতুন রোগী বেড়েছে আগের সপ্তাহের চেয়ে ৮ শতাংশ, নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ এবং মৃত্যু হয়েছে ৪৩ হাজারের বেশি মানুষের।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন রয়েছে। ওই অঞ্চলে আক্রান্তের হার ২৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ২৭ শতাংশ বেড়েছে। আফ্রিকায় এই হার বেড়েছে যথাক্রমে ১২ ও ১৪ শতাংশ। ইউরোপে আক্রান্তের হার ২ শতাংশ বাড়লেও মৃত্যুহার বাড়েনি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ইউরোপে সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে মার্চের শুরু থেকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত বাড়ায় তারা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে, বিশ্বের কিছু অঞ্চলে করোনাভাইরাসে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী থাকলেও ডব্লিউএইচও-র মতে, করোনার সকল ধরনের মধ্যে সদ্যোজাত ও বর্তমানে ক্রমবর্ধিষ্ণু ভ্যারিয়েন্ট বিএ.২-কেই সবচেয়ে বেশি সংক্রামক ধরন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যদিও, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি যে, এর কারণে গুরুতর অসুস্থতা দেখা দিতে পারে, তথাপি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রেও দ্রুতই ইউরোপের মত নতুন ঢেউ দেখা যেতে পারে সম্ভাব্য বিএ.২ এর ছড়িয়ে পড়া, বিধিনিষেধ শিথিল করা ও টিকার সুরক্ষা কমে আসার কারণে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশেও করোনায় মৃত্যুগতি আপাতত নিম্নমুখী। ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১২১ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৮৪৬ জনে। শনাক্তের হার ১ দশমিক ১১ শতাংশ। এই ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে কারো মৃত্যু হয়নি। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা (২৯ হাজার ১১৭) অপরিবর্তিতই থাকল এবং মহামারির প্রকোপের মধ্যেও আরেকটি মৃত্যুহীন দিন পরিসংখ্যানের তালিকায় যুক্ত হলো।

এমনই পটভূমিতে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ‘কোভিড-১৯ একসেস মরটালিটি টিম' ১৯১ দেশ এবং অঞ্চলের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ‘মহামারি’ ঘোষণা করল, তখন থেকে গত দুই বছরে অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে। এর ভিত্তিতে বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, তাদের একটি অংশ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, অন্যরা মারা গেছেন সংক্রমণ পরবর্তী জটিলতায়। এর কারণ, শ্বাসতন্ত্র, হৃদযন্ত্র, কিডনি রোগ বা উচ্চ রক্তচাপে যারা ভুগছেন, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঘটলে তাদের সেসব জটিলতা আরও বেড়ে যায়। গবেষণকার যে প্রক্রিয়ায় মৃত্যুর এই সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে, তাকে বলা হচ্ছে ‘অতিরিক্ত মৃত্যু’। মহামারি শুরুর আগে কী পরিমাণ মানুষ মারা যেত, তার সঙ্গে তুলনা করে কোভিডে বা কোভিডের প্রভাবে এই বাড়তি মৃত্যুর হিসাব তারা বের করার চেষ্টা করেছেন। এজন্য সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ‘ওয়ার্ল্ড মরটালিটি ডেটাবেজ’, ‘হিউম্যান মরটালিটি ডেটাবেজ’ এবং ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যাটিসটিসকস’ থেকে তথ্য নিয়েছেন গবেষকরা।

গবেষকরা বলছেন, দেশ ও অঞ্চলভেদে ‘অতিরিক্ত মৃত্যুর’ এই হারে পার্থক্য আছে। তবে এ গবেষণায় সামগ্রিকভাবে বিশ্বে গড় মৃত্যু হার দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ১২০ জন। এর অর্থ হল, ২০২০ সালের শুরু থেকে ২০২১ এর শেষ পর্যন্ত কোভিড মহামারিতে প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অথচ সরকারিভাবে ৫৯ লাখ মানুষের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে।

ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত তাদের এই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ এবং সাব-সাহরান আফ্রিকার নিম্ন আয়ের দেশগুলোতেই এই 'অতিরিক্ত মৃত্যু' বেশি হয়েছে। তবে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশেও কোভিডে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি। বলিভিয়া, বুলগেরিয়া, নর্থ মেসিডেনিয়া, লেসোথো এবং ইসোয়াতিনি- এই পাঁচ দেশে ‘অতিরিক্ত মৃত্যুর’ হার সবচেয়ে বেশি।

ওই গবেষণার বরাত দিয়ে আরও বিবিসি লিখেছে, যুক্তরাজ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে ১ লাখ ৭৩ হাহার মানুষের মৃত্যুর যে তথ্য এসেছে, তা সরকারি হিসাবের কাছাকাছি। সেখানে অতিরিক্ত মৃত্যুর হার দেখানো হয়েছে প্রতি লাখে ১৩০ জন। অন্যদিকে, ইন্সটিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের প্রধান লেখক ডা. হাইডং ওয়াং বলেছেন, 'জনস্বাস্থ্য সম্পর্তিক পরিকল্পনা সাজাতে মহামারিতে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা জানাটা জরুরি। সুইডেন, নেদারল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেসব দেশে ‘অতিরিক্ত মৃত্যুর’ প্রধান কারণ কোভিড। তবে বিশ্বের অনেক দেশের নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই।' কোভিডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা জানা সম্ভব হলে, তা পরে আরও গবেষণায় কাজে দেবে বলে মনে করে হাইডং ওয়াং।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম ৩ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ওই বছরের ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। গেল বছরের ৫ ও ১০ আগস্ট দুদিন সর্বাধিক ২৬৪ জন করে মারা যান। এভাবে উত্থান-পতন পেরিয়ে চলা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে বাংলাদেশসহ সব দেশকেই। অবজ্ঞায় উদাসীনতা দেখিয়ে কিংবা আতঙ্কের ভীত হয়ে নয়, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি, সতর্কতা, টিকাকরণ ও সচেতনতার মাধ্যমেই মহামারির এই ঘোরতর সঙ্কুল-সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করতে হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর