বেড়েছে আয়োজন, কমেছে আবেদন

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ  | 2023-08-30 05:20:42

২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। প্রতিবারের মতো এবারও নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু করে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদযাপিত হয়েছে বাঙালির গৌরবের এই দিনটি। প্রতিবারের মতো এবারও স্থানীয় কিছু অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, অনুভব করার চেষ্টা করেছি একাত্তরকে। নিবেদনের উপস্থিতি দেখার চেষ্টা করেছি, প্রশ্ন করেছি নিজেকে; অন্তত আয়োজক-আয়োজন ও অংশগ্রহণকারীদের দেখে। বলা যায়, হতাশ হয়েছি। হতাশার কারণ স্পষ্ট, উদযাপনের আনন্দে চাপা পড়ে গেছে আত্মত্যাগের ইতিহাস। অনেকেই সে ইতিহাসকে মুখে আনতে চায় না। আবার জানেও না অনেকেই। এই না জানা জনগোষ্ঠীকে আবার অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বলার উপায় নাই। রীতিমতো শিক্ষিত এবং অনেকেই তুলনামূলক নানা উচ্চ জায়গাতেই অধিষ্ঠিত।

পেশাগত ও সামাজিকভাবে কিছুটা হলেও উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকার কারণে কিছু অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে, এবং এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দেখেছি আয়োজকদের অনেকেই স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে সচেতন নন। কোন অনুষ্ঠানে কী ধরনের কর্মসূচি রাখতে হয় সে সম্পর্কেও অসচেতন। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের সঙ্গে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, দিবস সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সংবর্ধনা সভারও আয়োজন করে বসেছে। অথচ শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশিকায় বলা রয়েছে- ‘‘মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে।’’ বিশেষ এই দিনের আয়োজনে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সঙ্গে কেন বিদ্যালয়গুলো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ যুক্ত করবে, এটা নিয়ে জরুরিভিত্তিতে ভাবা দরকার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের সময়ে দেশাত্মবোধক সংগীতকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার সে ভিন্ন আয়োজন হতে পারত, স্বাধীনতা দিবসে এভাবে কেন? এতে করে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে, আয়োজকদের কাছে দেশের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত দিবসটির তাৎপর্য কি হারাচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে অবমূল্যায়িত হচ্ছে না?

গ্রামপ্রধান বাংলাদেশ। শহরের তুলনায় গ্রাম পিছিয়ে অনেকটাই। কেবল মানুষেরাই নয়, ওখানকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিরাও। তাদের অনেকের কাছে ছাব্বিশে মার্চের আবেদন, বিজয় দিবসের আবেদন, একুশে ফেব্রুয়ারির আবেদন এবং উদযাপন প্রায় সমপর্যায়ের। নানা সময়ের এমন নানা অনুষ্ঠানে বক্তাদের বক্তব্যে ছাব্বিশে মার্চকে বিজয় দিবসও বলতে শুনেছি। এমন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একুশে ফেব্রুয়ারির আলোচনা সভার মূল ব্যানারে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি সাঁটাতেও দেখেছি। তারা সাত বীরশ্রেষ্ঠ আর সালাম-বরকতের মধ্যকার ফারাক বুঝতে হয়ত অক্ষম। নানা সময়ে শোনা অনেকের বক্তব্যে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের কথাও শুনে আসছি। অবাক হওয়ার মতো তথ্য হলেও এগুলোই চলছে, এবং সমাজের শিক্ষিতসমাজ ও জনপ্রতিনিধিদের মুখ দিয়েই এগুলোর বেশিরভাগই বেরুচ্ছে।

এই ভুল ইতিহাসের চর্চা বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই সচেতনভাবে হচ্ছে বলে মনে করছি না। এগুলো অসচেতনতায় হচ্ছে, অজ্ঞতায় হচ্ছে। অনেকেই জানে না কোন তারিখে কোন দিবস, কী তার আবেদন, কী তার ইতিহাস। ফলে ভুলভাবে উদ্ধৃত হচ্ছে তাদের মুখ থেকে। এ ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার লোকও খুব একটা নেই, আবার যারা আছে তারা হয় জানে না, নয়তো এনিয়ে কথা বলে না! ফলে সাধারণের কাছে, অনতিতরুণ এবং শিশুশিক্ষার্থীদের কাছে ভুলভাবে যাচ্ছে ইতিহাস। হ্যাঁ, তাদের পাঠ্যবইয়ে দিবসগুলোর কথা লিখা আছে, তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নানা ‘বিদগ্ধজনের আলোচনায়’ যে ভুল তাদের কানে আসছে তার শক্তি পাঠ্যবইয়ের তথ্য ও ইতিহাসকে কি আড়াল করে দিচ্ছে না?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত জাতীয় দিবসগুলো জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। প্রশাসনের উদ্যোগে, প্রশাসনিক নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শোক দিবস, শহিদ দিবসসহ নানা দিবসে সাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকা পড়েছে। আগে জাতীয় নানা দিবসে গ্রামপর্যায়েও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগ পালন করত। টানা তিন মেয়াদের ক্ষমতায় থাকার এই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষেরা যেমন ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন দিবসী আয়োজনে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হারিয়েছে তেমনি হারিয়েছে দলটির প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মী-সমর্থকেরাও। ফলে এমনিতেই ইতিহাসবিস্মৃত জাতি আরও বেশি ইতিহাসবিমুখ হয়ে পড়ছে। যে ক্ষতি একান্তই দেশের!

হ্যাঁ, প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এবং প্রশাসনের উদ্যোগে জাতীয় প্রতিটি দিবসে নানা আয়োজন থাকে, কিন্তু সেখানে সাধারণের অংশগ্রহণ কম কিংবা সুযোগ নেই। এতে ইতিহাস-আশ্রিত দিবসগুলো মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। আর প্রশাসনিক নির্দেশনার অনুষ্ঠানে নানা কর্তৃপক্ষ আয়োজন করলেও সেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা দিন দিন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরাই। এবার স্বাধীনতা দিবসে আরেকটা খবর অনেকের চোখে পড়েছে নীলফামারীর ডোমারের উপজেলা চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদকে ‘রাজাকারের সন্তান’ আখ্যা দিয়ে অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত। অনুষ্ঠান বর্জন প্রসঙ্গে ডোমার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নুরন্নবী জানান, ‘‘উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদের বাবা শওকত আলী ছিলেন রাজাকার সদস্য। তিনি উপজেলার বোড়াগাড়ী ইউনিয়নের পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন। এলাকার কুখ্যাত রাজাকার সামছুল হক টগরার ঘনিষ্ঠ সহচর থেকে তোফায়েলের বাবা যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন ও লুটপাটে সহযোগিতা করেন। তার ছেলে তোফায়েল ছিলেন ফ্রিডম পার্টির, ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী বিশ্ব দুলালের উপজেলার সমন্বয়কারী। তিনি সব সময় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অবজ্ঞা করে আসছে। এসব ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পেতে এই রাজাকারপুত্র সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেন। এই অনুপ্রবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি বাগিয়ে নিয়ে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকের ওপর ভর করে গত নির্বাচনে বনে যান উপজেলা চেয়ারম্যান। রাজাকারের ছেলের জাতীয় পতাকা উত্তোলনকে আমরা জাতীয় পতাকার অবমাননা মনে করে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের উপজেলার মাঠের অনুষ্ঠান বর্জন করেছি। [জনকণ্ঠ ২৬ মার্চ ২০২২]।’’ কেবল এবারই নয়, গতবারও এমন ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এই উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরোধিতা করে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন, তবু কাজ হয়নি। কেন হয়নি? কারণ ওই একই- সরকারি নির্দেশনার আলোকে পতাকা উত্তোলন! এতে দিবসী আয়োজন হয়তো হচ্ছে, কিন্তু স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ নানা দিবসের আবেদন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

দণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মাওলানা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর পুত্রসহ বিতর্কিত আরও অনেককে স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত নানা অনুষ্ঠানে মুখ্য ভূমিকায় থাকার সংবাদ নানা সময়ে আমরা দেখেছি, এখনও বিতর্কিতদের অনেককে দেখছি। এসবের মাধ্যমে দিবসী আয়োজন হয়ত সম্পন্ন হচ্ছে কিন্তু আবেদন কি থাকছে? একাত্তরকে উপজীব্য করা জাতীয় নানা অনুষ্ঠানে যখন একাত্তরই বিস্মৃত হয়ে যায় তখন আমাদের থাকেই বা কী! আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে আবেদন থাকতে হবে অনুষ্ঠানে। তা না হলে ব্যর্থ হবে সব; সবকিছু!

এ সম্পর্কিত আরও খবর