মূল্যস্ফীতিতে চড়ুইভাতি ও বাবুর্চির গানে জিভে কামড়

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 05:20:33

 

শিরোনামটি শুনে হয়তো সবাই অবাক হবেন। কেউ হয়তো হেসেই ফেলবেন। আমিও প্রথমে এমন উক্তি শুনে হেসে ফেলেছিলাম। বলেছি, ছাগল কি কখনও কাউকে কামড়ায়? এমন ঘটনা কি কেউ কখনও শুনেছে বা দেখেছে? কি সব আজগুবি কথা শোনাচ্ছেন আপনি!

হ্যাঁ, করোনাকাল হলেও এবছর দুটো চড়ুইভাতিতে অংশগ্রহণ করা হয়েই গেল আমার। এতদিন করোনার জন্য দল বেঁধে বাইরে যাওয়া নিশেধ ছিল। সংক্রমণ কমে যাবার সাথে সাথে কোথাও কোন বিধি-নিশেধ চোখে পড়ছে না। গত দু’মাস থেকে শুক্রবার জু’মার নামাজে সবাই করোনা শুরুর আগেকার দিনের মতো গাদাগাদি করে নামাজ আদায় করেছেন। পাবলিক বাসে-ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধির বিধি নিশেধ নেই।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সাথে সাথে শ্রেণিকক্ষে শারিরীক উপস্থিতির মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলেও কোন শ্রেণিতে ৮০ জন শিক্ষার্থীর জন্য নতুন করে আর কোন আসন বসানোর জায়গা নেই। তাই সেটা মানা সম্ভবও হয়নি। তারা এক বেঞ্চে ঘেঁষাঘেঁষি করে ৫-৬ জন বসছে। গণমাধ্যমে এখনও সতর্কতামূলক কথা প্রচারিত হলেও বাস্তবে সেটা কোথাও মেনে চলার অবকাশ নেই বলে মনে হচ্ছে।

বহুদিন পর সবাই একসাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে গেছে। প্রতিটি বর্ষের শিক্ষার্থীরা গরমকাল শরু হবার পূর্বেই গত দু’বছরের পেন্ডিং অনুষ্ঠান, পিকনিক করার জন্য যেন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। যদিও এখনও অফিসিয়ালী দূরে কোথাও পিকনিক করতে যাবার অনুমতি দেয়া হয়নি তদুপরি ওরা ছুটির দিনে নিজ নিজ বর্ষের সতীর্থদের নিয়ে ক্যাম্পাসের আম্রকাননে বা পার্কের মধ্যেই পিকনিকের আয়োজন করছে। পদব্রজে বাসা থেকে কয়েক মিনিটে আয়োজনস্থল হওয়ায় মিষ্টি রোদে হেঁটে ওদের অনুরোধে এমন অনুষ্ঠানে গিয়ে আনন্দের ভাগীদার হতে দোষ কোথায়? কয়েক সপ্তাহ পূর্বে এমএস শ্রেণির মৌখিক পরীক্ষা শেষ হবার পরদিনই ওদের পিক্নিকে অংশ নিয়েছি। তাই আজ এদের জোড়ালো অনুরোধও রক্ষা করতে হলো।

ফাগুণের এসময় আমগাছগুলো মুকুলে ভরপুর। তাই গাছ থেকে একটু দূরে ইট সাজিয়ে খোলা চুলায় রান্না হচ্ছে। আমার এসব রান্নাবান্না দেখতে বেশ ভাল লাগে। হলের বাবুর্চিকে দিয়ে রান্না করানো হচ্ছে। সে তার সহযোগিকে দিয়ে এটা ওটা আদেশ করে নিজে নেড়েচেড়ে রান্না করছে। বড় ডেগে মাংস রান্না হচ্ছে। গতরাতে সে বাজারের তালিকা করে নিজে বাজারে গিয়ে কেনাকাটায় সহায়তা করেছে। মরিচ-মশলা বেঁটে এনেছে। ওকে বললাম খাসীর মাংস বুঝি? এখন খাসীর মাংসের কেজি প্রতি দাম কেমন? সে বলল, হঠাৎ করে বিয়ে-সাদী ও পিক্নিকের মওশুম শুরু হয়ে যাওয়াতে বাজার বেশ গরম স্যার। প্রতিটি জিনিসের দাম বেশ চড়া। ইউক্রেন না কোথায় জানি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেজন্য বাজারে ভোগ্যপণ্যের দামে আগুন লেগেছে!

একনাগাড়ে সে বক্তব্য শুরু করলো। যেন থামতেই চাচ্ছে না। আমার একজন কলিগ মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় রান্নার দৃশ্য ধারণ করছিল। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ তাদের মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এর ক্ষণিক পর একটি বড় আমগাছের ছায়ার নিচে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বাবুর্চির সাথে আলাপচারিতায় মেতে গেলাম।

সে অনেক কথা শোনালো। সে ভালো গানও গাইতে পারে বলে জানালো। ছোটবেলায় গ্রামে যাত্রা ও কুশাইন গান শুনতে যেত। সেসব গানে হরিদয়াল নামের এক দোয়াড়ী (কৌতুককারী বিবেক, রংবাজ) সে প্রায়শই: একটি গান গেয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি ও মজা করে দর্শক হাসাতো। তা হলো- ‘মাগো মা, ওগো মা, ছাগল কামড়াইলে মানুষ বাঁচে না’। স্যার কি আর বলবো, ছাগলের মাংস খুব সুস্বাদু বলে হিন্দু-মুসলিম সব জাতির মানুষরাই খান। এখন বাজারে যে ভোগান্তি শুরু হয়েছে তাতে ছোটবেলার শোনা অদ্ভুত গানের মতো কথাটা সত্যি হচ্ছে বলে মনে হয়। আমি ওর গানের কলি শুনে জোরে হেঁসে দিলাম। অনেকে জিভে কামড় দিল।

কেনই বা হাসবো না? আমার সাথে পাশে বসা সবাই ওর গানের কলি শুনে আমার আগে অট্টহাসি শুরু করে দিয়েছে যে! আসলে সে বাবুর্চি হলেও একজন খোলা মনের রসিক মানুষ। কথার রস দিয়ে পিকনিকের এই জায়গাটা যেন আরো আনন্দে ভরিয়ে রেখেছে সে।

এরপর হঠাৎ তার কণ্ঠস্বর করুণ হতে শুরু করলো। সে জানালো ৬০০ টাকার খাসির মাংস গত দু’বছরের মধ্যে বেড়ে ১১০০ টাকা হয়ে যওয়ায় তার বাড়িতে ছেলের জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেটা কিনতে সাহস করেনি। তার স্বর দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো যেন। আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে লাগলাম। এক সময় উঠে একাডেমিক ভবনের দিকে একা একা চলে গেলাম। কক্ষে বসে অনলাইনে যুদ্ধের খবর দেখতে দেখতে একসময় বাজারে ভোগ্যপণ্যের অগ্নিমূল্যের সংবাদে চোখ আটকিয়ে গেল।

আবার বাবুর্চির চোখ ছল ছল হবার কথা মনে হতে লাগলো। একটি পত্রিকায় দেখলাম, বাজারে কিছুুদিন আগের ৩০ টাকার মোটা চাল এখন ৫০ টাকা কেজি। ১৩০ টাকার সয়াবিনের দাম উঠেছে ২০০ টাকায়। সেটা আবার বোতলজাত। ৫ লিটারের বোতলের দাম উঠেছে ৮০০ টাকা। বাজার থেকে খোলা সয়াবিন তেল উধাও হয়ে গেছে। খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে দোকানীরা।

ব্যবসায়ীদের গুদামে চাল, ডাল, আটা, সয়াবিন, মসুর সবকিছুুই মজুদ আছে। কিন্তু গালামাল বা কাঁচা বাজারের দোকানে সংকট বলে দাম বাড়ানো হচ্ছে। চালের বাজারে চালবাজি, তেলের বাজারে তেলেসমাতি শুরু হয়ে গেছে। ওরা যুদ্ধের উপমা দিয়ে বাজারে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিজেরাই নির্ধারণ করে দাম হাকাচ্ছে। কোন কোন ব্যবস্যায়ী বেশী দাম হাঁকিয়ে বলছেন, “ নিলে নেন, না নিলে চলে যান”।  যেন বিষয়টি মগের মুল্লুক!

মার্চ ৬ তারিখে রাজধানীর কাঁচা সব্জীর বাজারে করলার কেজি ১২০ টাকা, বরবটীর কেজি ১৬০ টাকায় উঠেছে বলে এক টিভি সংবাদে জানা গেল। দেশে কৃষিতে বাম্পার ফলন হচ্ছে। নগর কৃষি, ছাদ কৃষি, পানিতে ভাসমান কৃষি তবুও অভাব কেন? এত উৎপাদন তবুও চাল আমদানীতে বাংলাদেশ এখনও ২য় কেন? আসলে আমাদের দেশে কৃষি জমি নেই ৫৬ ভাগ মানুষের। তাহলে বুঝা যায়, এত উৎপাদন বাড়ে কার জমিতে। উৎপাদিত ফসল জমা হয় কার গুদামে। কোন সিন্ডিকেট তা নিয়ন্ত্রণ করে তা সরকারের জানা থাকার কথা। এতকিছু জানার পরও ভোক্তা দুষেণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে, দোকানদার দুষেণ মহাজনদেরকে। আর মহাজনরা দুষছেন মজুতদারী, অতি মুনাফালোভী সিন্ডিকেটকে। বাজার যখন  এদের কারসাজিতে বেসামাল হয়ে পড়ে তখন সরকারী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তারা তখন কোনরূপ সঠিক তদন্ত ব্যতিরেকে লোকের উড়ো কথা শুনে কিছু আড়তে গিয়ে দরজায় সিলগালা করে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার দায় সারেন।

এছাড়া ১২ কেজির গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ১৩০০ টাকা, ২২ কেজির দাম ২৫২৯ টাকা। একমাসে দু’বার গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে রাজধানীর আফতাবনগরের মতো এলাকায় যেখানে পাইপে গ্যাস সংযোগ নেই তারা একবেলা রান্না বন্ধ রেখেছেন।

যুদ্ধের দোহাই দিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন অনেকে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে- বলতে নারাজ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা-ক্যাব। এর জন্য লোভী ব্যবসায়ী ও সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা দায়ী। আমাদের দেশে ৭০-৮০ ভাগ আইন প্রণেতা বা সাংসদ ব্যবসায়ী। একথা অনস্বীকার্য যে, ব্যবসায়ীদের পারস্পরিক দোষারোপ করার প্রবণতা আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের বাজারকে কিছুদিন পর পর অস্থিতিশীল করে তুলছে। অসাধু সিন্ডিকেট এদের সহযোগিতায় গড়ে উঠতে মদদ পাচ্ছে। ফলে কম খেয়ে নাভিশ্বাস উঠছে নিম্ন আয়ের মানুষ ও অতি দরিদ্র ভাসমান পরিবারগুলোর। তারা বাধ্য হয়ে টিসিবি-র ট্রাক সেলের পণ্য কম দামে পেতে বার বার লাইনে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য না পেয়ে হতাশা ব্যক্ত করছেন।

শিরোনামে ছাগলের কথা শুরু করেছিলাম। ছাগল নামক প্রাণিটি সব ধরণের গাছপালা খেয়ে সাবাড় করে দেয়। আর খাসী ছাগল হলে সেতো সবকিছুতে কামড়ায় ও খেতে না পারলেও বার বার কামড়িয়ে নষ্ট করে। যাতে সেটা আর বেড়ে উঠতে না পারে। তাই কোন বাড়িতে লাগামহীন ছাগল পালন করলে সে বাড়িতে বাগান করা দায়। সেখানে কোন দামী বা ঔষধি গাছপালা বাড়ে না। তাই রোগ-শোক লেগেই তাকে সেই বাড়িতে। তবে ছাগল মানুষের উপকারী বন্ধুর মতো। ছাগল পালন করে অনেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। ছাগলের সাপের মত বিষদাঁত নেই। তারা মানুষকে কখনো কামড়ায় না। যদি ছাগল কখনোও পাগল হয়ে যায় তাহলে রাগ করে মানুষকে কামড়াতে পারে। তবে পাগল ছাগলে কাউকে কামড়ালে তার দ্রুত চিকিতসা করা উচিত।

আমাদের দেশে অসাধু সিন্ডিকেট বা ছাগল সদৃশ এই প্রাণিটি উন্মাদের মতো সব জায়গায় উপকারী জিনিষ নিজেরাই ভাগ-বাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলছে অথবা নষ্ট করে দিচ্ছে। তারা সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষের সুখ-দু:খের সাথী হতে পারছে না নিজেদের ইন্সটিংক্ট বা সহজাত এবং স্টেরিওটাইপ চরিত্রের কারণে। আমাদের আয়-ব্যায়ের লাগামহীন ফাঁরাক চরম সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে তুলেছে-যেটা মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তির সীমাকে অসহ্য করে ফেলেছে। এটা শুণ্যসীমায় আনার নীতি গ্রহণের জন্য আশু পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। নতুবা চড়ুইভাতির সেই বাবুর্চির কুশাইন দোয়াড়ীর গানের কলির মত ‘মাগো মা, ওগো মা, ছাগল কামড়াইলে মানুষ বাঁচে না’-র  মতো অবস্থা বাস্তবে রূপ নিতে দেরী হবে না।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর