‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা’ তরুণ প্রজন্ম ও নির্বাচনী ইশতেহার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আসাদুজ্জামান কাজল | 2023-08-25 23:58:49

দেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৩০ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতে ব্যস্ত। প্রতিটি রাজনৈতিক দল দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করছে। তবে, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সবথেকে গুরুত্ব দেবে তরুণদের। তরুণদের কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

বর্তমানে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ এই তরুণ প্রজন্ম। এই সম্পদকে এখনই সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে এই তরুণ প্রজন্মই আগামী ৩০-৩৫ বছর পর রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে পড়বে। তাই এই তরুণদের কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নতির জন্য চিন্তার সময় এখনই। বিষয়গুলো অনুধাবন করেই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই কথা বলেছেন তরুণদের সাথে। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এই প্রথম দেশের তরুণদের জানতে ও বুঝতে সরাসরি তরুণদের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বাগত জানাই এই উদ্যোগকে।

বর্তমানে যেহেতু দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তরুণ তাই এই তরুণদের মাধ্যমেই দেশের উন্নয়ন জোরদার করতে হবে। প্রতিটি তরুণকে তার মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে কর্মক্ষম করে তোলার মাধ্যমেই এই দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। আমি নিজে একজন তরুণ শিক্ষক এবং নিজের লেখাপড়ার বাইরে দিনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করি তরুণদের সাথে। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তরুণদের সঙ্গে চলাফেরার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেছি- আসলেই বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এই রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী প্রত্যশা করে।

তরুণরা তাদের হাতের মুঠোফোনের মাধ্যমেই জানতে পারে উন্নত বিশ্বের নাগরিক কেমন জীবন-যাপন করে। যেহেতু দেশ ডিজিটাল হয়েছে, মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হয়েছে তাই, তরুণদের মাঝে আন্তর্জাতিক মানের জীবন-যাত্রার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটা তাদের পোষাক, চলা-ফেরা, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই দৃশ্যমান। দেশ এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তরুণদের মাঝে এই স্বপ্ন ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। তারা সত্যি সত্যি আর্ন্তজাতিক মানের জীবন উপভোগ করতে চাই। যেখানে আন্তর্জাতিক মানের লেখাপড়ার সুযোগ থাকবে, লেখাপড়া শেষ হবার সাথে সাথে সবার কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে, মুক্ত-চিন্তার সুযোগ থাকবে, স্বাধীনভাবে কাজ করার ও কথা বলার সুযোগ থাকবে, ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে গ্রহণ করবে এবং সর্বোপরি এগুলোর মাধ্যমে প্রত্যেকেরই সুন্দর ও সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের ফলে আমাদের ঝড়ে পরার হার কমেছে এবং শিক্ষিতের হার বেড়েছে। কিন্তু পাসের হার যেভাবে বেড়েছে সেভাবে কি শিক্ষার মান বেড়েছে? আমারা কি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে পেরছি? দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার মান নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে।

একই বিষয় দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা দেশে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে যখন উন্নত দেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ ডি ভর্তির জন্য আবেদন করে তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সরাসরি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ভর্তি করা হয় না। কারণ হিসেবে তারা পরোক্ষভাবে বলে দেয়-আমাদের দেশের মাস্টার্স ডিগ্রি তাদের মানের নয়। সুতরাং, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা কোনো পর্যায়েই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের উচ্চশিক্ষা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই সম্পন্ন করে। যদিও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল খরচ রাষ্ট্রই বহন করে তারপরও এই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক খরচ থেকে যায়- যেটা আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীর জন্যই কষ্টকর। একই সাথে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থীকে পড়ার সুযোগও দিতে পারছি না। অনেকে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে এবং এটা বেশ ব্যায়সাধ্য। তাই সরকার আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার খরচ মেটানোর জন্য উন্নত রাষ্ট্রের ন্যায় বিনা জামানতে কম সুদে উচ্চ শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। যেখানে ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর তার নিজের শিক্ষা খরচ নিজেই পরিশোধের সুযোগ পাবে।

প্রতিটি তরুণই চাই- লেখাপড়া শেষে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ মেধা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ। হাতে গোনা দুই-একজন বাদে লেখাপড়া শেষে প্রায় প্রত্যেকেরই তিন থেকে চার বছর অপেক্ষা করতে হয় কর্মসংস্থানে প্রবেশ করতে এবং এরপরেও বেশিরভাগই কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাতে পারছে না। কেননা, নানা চেষ্টার পরেও সরকারি ও বেসকরারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।

যেহেতু সকলকে একই সাথে চাকরি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না তাই সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। যেন, লেখাপড়া শেষে শিক্ষিত তরুণরা চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই আরো কয়েকজনের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য বিনা জামানতে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। একইসাথে শ্রমিক রপ্তানি না করে, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে তরুণরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পাবে এবং দেশ আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।

আগের তুলনায় বর্তমান তরুণদের কাছে তথ্য অনেক বেশি সহজলভ্য। মুহুর্তেই তারা দেশ-বিদেশের জ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে পারে। বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনভাবে জ্ঞান চর্চা, চিন্তা-ভাবনা ও জীবন-যাপনের সুযোগ চায়। তাই দেশের কোনো আইন বা নীতিমালা দিয়ে তরুণদের এই স্বাধীনতা রোধ করা কোনো তরুণ বান্ধব সরকারের জন্য উচিত হবে না।

তরুণদের আরেকটি বড় চাওয়া বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। যেখানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। কিন্তু এটা সম্ভব হয় না অবৈধ্য বা অনৈতিক লেনদেন বা স্বজনপ্রীতির কারণে। অর্থাৎ দুর্নীতির কারণে। তরুণ সমাজ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ দেখতে চায়। যেখানে প্রত্যেকেই তার মেধার ও যোগ্যতার মূল্যায়ন পাবে।

এই রাষ্ট্রের সকল অনিয়ম দূর করা সম্ভব শুধু এই দুর্নীতি বন্ধের মাধ্যমে। শুধু দুর্নীতির জন্যই প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম বিদ্যমান। যেহেতু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তরুণ প্রজন্মের সাথে আলোচনায় বসেছেন তাই তার রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশে গড়ার অঙ্গিকার জোড়ালোভাবে ব্যক্ত হওয়া প্রয়োজন।

দিনশেষে প্রত্যেকেই তার নিজের জীবনের নিশ্চিয়তা চায়। এই তরুণ প্রজন্মই সামনে রাষ্ট্রের সিনিয়র সিটেজেনে পরিণত হবে। রাষ্টের সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তাও চায় এই তরুণ প্রজন্ম। কল্যাণকর রাষ্ট্রের ন্যায়- রাষ্ট্রের সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকান ড্রিম’এ তাদের রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করার জন্য গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও স্বাধীন সমাজের কথা বলা হয়েছিল। যেখানে প্রত্যেকেই তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, অন্য কোনো উপায়ে নয়। বিশ্বের অনেক দেশ এই ‘আমেরিকার ড্রিম’ এর আদলে তাদের নিজের দেশের ড্রিম তৈরি করেছে। এর ভিতরে ব্রিটেন, রাশিয় ও চায়না অন্যতম। ব্রিটেন এই ড্রিম এর আওতায়, তাদের প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি ঘড়ের নিশ্চয়তার লক্ষে কাজ করেছিল।

আমরাও আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট চিন্তা করে সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের জন্য একটি বাংলাদেশ ড্রিম তৈরি করতে পারি। যেখানে আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিকের উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তার জন্য সরকার ও সাধারণ জনগণ একসাথে কাজ করবে। যেখানে প্রত্যেকেই তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়িত হবে এবং রাষ্ট্র থেকে সকল অন্যায়-অনিয়ম দূর হয়ে সত্যিকারের উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আসাদুজ্জামান কাজল: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর