নির্বাচন: সংকট না সম্ভাবনা?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. হারুন রশীদ | 2023-08-31 23:07:18

 

প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল। ঋতুর পালাবদলের পরিক্রমায় শীত আসি আসি করছে। এরইমধ্যে ধানকাটা শুরু হয়েছে। কাটাশস্যের নাড়াপুচ্ছে জমতে শুরু করেছে শিশির। কৃষিজীবী সমাজে নতুন শস্য নবান্ন উৎসব নিয়ে আসে। শীতে পিঠাপুলির আয়োজনে মাতে বাঙালি সমাজ। রাজনীতি প্রভাবিত সমাজে নির্বাচনও একটি উৎসব।

এবারের একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বইছে নির্বাচনী হাওয়া। শীতের হিমেল হাওয়ায় তা উত্তাপ নিয়ে আসছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, সমর্থক, ভোটাররা তুমুল উত্তেজনায় আছেন। চায়ের কাপের ধূমায়িত আড্ডায় আলোচনার কেন্দ্রে জাতীয় নির্বাচন। কে কোথায় প্রার্থী হচ্ছেন। কার জোটে কে যাচ্ছেন ইত্যাকার আলোচনায় কোলাহলমুখর এখন নির্বাচনী জনপদ।

বড় দুই দল ও জোটের প্রার্থীদের ঘিরেই নির্বাচনী আলোচনা তুঙ্গে। বাদ যাচ্ছে না ড. রেজা কিবরিয়ার ঐক্যফ্রন্টে যোগদান থেকে শুরু করে হিরো আলমের এমপি পদে দাঁড়ানো পর্যন্ত কোনোকিছুই।

রাজনীতি প্রভাবিত সমাজে রাজনীতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। টিভি টকশো, মাঠে-ময়দান, চায়ের দোকানে রাজনীতি। রাজনীতির মধ্য দিয়েই গণআন্দোলন সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতিকে তৈরি করেছিলেন। যা পরে সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা লাভ করি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড। লাল সবুজের পতাকা।   

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এখন অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতি ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েই গেছে। সমস্যা সবচেয়ে প্রকট হয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। আস্থার সংকট এক্ষেত্রে তীব্র। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল। যাচ্ছেতাই ব্যবহারে সেই ব্যবস্থাও বিতর্কিত হয়ে পড়ে। পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনেই হবে নির্বাচন।

সংলাপ, জোট, পাল্টা জোটের পথ পেরিয়ে দেশ এখন নির্বাচনমুখী। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এটি এ পর্যন্ত যে কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে তাতে দৃশ্যমান। গোটা জাতি অপেক্ষা করছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের দিনটির জন্য। এরই মধ্যে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।

নির্বাচন কমিশন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও জোট এমনকি ভোটার সমর্থকরাও যার যার মত করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে নানা পক্ষই অভিযোগ নিয়ে হাজির হচ্ছে। প্রশাসনে রদবদলসহ নানাবিধ দাবি থাকছে তাতে। বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমতল ক্ষেত্র তৈরি হবে সবার জন্য এটি মৌলিক দাবিতে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচনে বাড়তি তর্ক যুক্ত হয়েছে ইভিএম নিয়ে। ইভিএম নিয়ে বরাবরই আপত্তি বিএনপির। ঐক্যফ্রন্টও এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তবে তা সীমিত আকারে। ডিজিটাল বাংলাদেশে নির্বাচনকে প্রযুক্তিবান্ধব করতে তাদের এই উদ্যোগ।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আইনি ভিত্তি দিয়ে গত ৩০ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। পরে তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার পর ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটি আইনি ভিত্তি পেয়েছে।

ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশন ইভিএম ভীতি কাটাতে এবং এ ব্যাপারে ভোটারদের সচেতন করতে ইভিএম মেলাসহ নানাবিধ কার্যক্রম চালিয়েছে। এরপরও পুরোপুরি ইভিএম ভীতি দূর হয়েছে এটি বলা যাবে না। বরং ইভিএম নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি- এটিই বলা যায়।

সত্যি বলতে কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন না মানার সংস্কৃতি অধিকমাত্রায় ক্রিয়াশীল। একদল কিছু একটা করতে চাইলে অন্যদল বুঝে না বুঝে সেটার বিরোধিতা করবে। নির্বাচন কমিশনের ইভিএম ভোট পদ্ধতি চালু করার বিষয়েও এই মনোভাব কাজ করেছে। 

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ধ্যান ধারণায় পাল্টে যাচ্ছে। বর্তমান একংবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্ব প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেকদূর এগিয়েছে। আর প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের অনেক জটিল কাজকে সহজ করে দিয়েছে। জীবনকে করেছে স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং গতিশীল। দেশের মানুষ এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তিগত অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে।

সভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারায় বর্তমান বিশ্ব অনেকাংশেই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের যুগে এসে আমাদের প্রযুক্তি বিমুখকতার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন পদ্ধতি চালু নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তা আসলে প্রযুক্তি ভীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা এক ধরনের গোঁড়ামিরও পরিচয়। এছাড়া অকারণ বিরোধিতার সংস্কতিও এ জন্য দায়ী।

শুধু ইভিএমের ক্ষেত্রেই নয়। অকারণ বিরোধিতার রীতি সর্বত্র। সরকারি দলের ভাল কাজেও বিরোধী দলের না। আবার বিরোধী দল ন্যায্য কথা বললেও সরকারি দল তা আমলে নেয় না। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলও সরকারের অংশ। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে তাহলে আমরা সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তা মেনে  নেব।’ আমাদের দেশের রাজনীতিতে কি এই সংস্কৃতি আছে?

নির্বাচন এলে সবাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলে। কিন্তু এটা তো কেবল নির্বাচনের বিষয় নয়। সারা বছর ধরে গণতন্ত্র চর্চার মধ্য দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের একটি আবহ সৃষ্টি হয়। এটি হলে নির্বাচনকালীন আর আলাদা করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবির প্রয়োজন হয় না। আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ক্রমে এই পরিবর্তন দেখতে পাবো বলে আশা রাখি। 

নতুন কিছুকে গ্রহণ করার জন্য আধুনিক চিন্তাচেতনার অধিকারী হতে হয়। কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করার আগেই এ নিয়ে অযথাই ভয় বা আশঙ্কা প্রকাশ কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার হতে পারে না। আসলে যে কোনো যন্ত্রের ব্যবহারই নির্ভর করে যিনি সেটা অপারেট করছেন তার ওপর। মোটকথা সদিচ্ছার ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। এখানে পদ্ধতি কোনো বিষয় নয়।

কোনো নির্বাচনের ফলাফলই কি পরাজিত দল ভালোভাবে নিয়েছে? তাহলে পদ্ধতির দোহাই কেন? বিশ্লেষকদের মতে, ইভিএম পদ্ধতির অনেক উপযোগিতা রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় এটি যুক্ত হলে তা একটি আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে অকারণ বিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে আসাই হবে যুক্তিযুক্ত।

নির্বাচন কমিশন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হওয়া সত্ত্বেও ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য কমিশনকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ইভিএমে ভোট পরিচালনা করতে হবে। কোনো পক্ষই যেন ইভিএমের ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেটিই প্রমাণিত হবে। তখন নির্বাচন কমিশন প্রশ্নের মুখে পড়বে।

ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। এই মাসে বাঙালি নতুন করে দেশগড়ার শপথ নেয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি নির্বাচনকালীন সংকটকে সম্ভাবনায় পরিণত করে গণতন্ত্রের পথে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাক- এটিই প্রত্যাশিত।

ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক, কলামিস্ট।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর