অনুপ্রেরণামূলক 'রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়'

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 18:19:29

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা ও দর্শনের মূলমন্ত্র ধারণ করে 'রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার সংবাদ নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক এবং অনুপ্রেরণার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং খ্যাতনামা শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ১৪ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ড এর পরিচালনায় রয়েছেন। বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব রবিন খান ট্রাস্টি বোর্ডের সচিব ও সমন্বয়কারী ট্রাস্টি। যার অবস্থান ৯৭ শাহ্ মখদুম এভিনিউ, সেক্টর ১২, উত্তরা, ঢাকা ১২৩০।

সত্য কবুল করতে দ্বিধা নেই যে, আমরা উচ্চশিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছি বাংলাদেশের চারটি জেনারেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী কালপর্বে। বুয়েট-সহ সে আমলে সাকুল্যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল পাঁচটি। সে কাল সত্যিই তিরোহিত এবং যুগধর্মের দাবি মেনে দেশে এখন পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে কাজ করছে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই গুণ ও মান সম্পর্কে রয়েছে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক।

তথাপি, এহেন পটভূমিতে বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি এবং তাদের কিছু কিছু শিক্ষক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে ধন্য। দেশের বিপুল শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে ও তাদের জীবন-জীবিকার বিকাশের পথে সেসব উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের অবদান ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। এবং এমনই বাস্তবতায় 'রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়'-এর উন্মেষ আশা জাগানিয়া আবহ স্বরূপ, যা আরও যথাযুক্ত হয়েছে রবীন্দ্র শিক্ষাচিন্তা ও দর্শনে উজ্জীবিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের যোগদানের ফলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমকালীন পণ্ডিতদের মধ্যে বরিষ্ঠতম ও অগ্রগণ্য। আবহমান বাংলার শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সৃজনশীল অবদান ও মননশীল দক্ষতার ফলিত রূপ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর প্রণীত বহু গবেষণা, গ্রন্থ ও আলোচনায়। যার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো চর্যাপদ বিষয়ক ইতিহাস সৃষ্টিকারী তাঁর সর্বসাম্প্রতিক গবেষণাকর্ম। অতিসম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত বিদগ্ধ অধ্যাপক ড. ভূঁইয়া ইকবাল স্মারক গ্রন্থ সম্পাদনায় তিনি আর্দশ-দৃষ্টান্তের প্রকাশনার নমুনা পেশ করেছেন।

ফলে উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের যোগদানের মাধ্যমে সুযোগ্য উদ্যোক্তা ও ট্রাস্টি বোর্ড-এর গতিশীল পরিচালনায় 'রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়' অনন্য উচ্চতায় আসীন হবে বলে প্রত্যাশা করাই সঙ্গত। বিশেষত, একুশ শতকের জাতীয় ও বৈশ্বিক উভয় অর্থনীতিতেই সৃজনকলা সম্পর্কিত শিল্প-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ব্যাপক। দৈনন্দিন জীবনে ললিতকলা, চারু ও কারুকলা, অলঙ্করণ ওগণমাধ্যমের প্রভাব গভীর হলেও আমাদের জীবিকা ও পেশাগতচর্চায় তা এখনও যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না।

এই প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে এই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। এখানে দৃশ্যকলা ও পরিবেশনকলা, নকশা ও উদ্ভাবন, গণযোগাযোগ ও গণমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তি, সমাজবিদ্যা ও ব্যবসাবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে। আশা করা যায় যে, এ বিশ্ববিদ্যালয় সৃজনকলার ক্ষেত্রে অধ্যয়ন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণকে এমনভাবে গুরুত্ব দেবে, যাতে এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটিয়ে এই ধারার শিল্পের নানা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের জন্য উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে ওঠে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 'রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়' বাংলাদেশের একটি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। মনন ও দর্শনের বিবেচনায় এই বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র। সমাজ-উন্নয়ন, শিক্ষাচিন্তা, ব্যবস্থাপনা-ভাবনা, সংস্কৃতিচর্চা ও নানা সৃজনশীল কর্মে নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদৃষ্টি বাঙালির চিরকালের পাথেয়। সেই গৌরবদীপ্ত পথ ও পাথেয় অবলম্বনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নানা ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতির সংযোজন করে শিক্ষাপ্রণালি আনন্দদায়ক এবং উচ্চশিক্ষাকে উৎকর্ষময় করতে সচেষ্ট হবে 'রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়', যা শিক্ষার্থীর আলেকিত জীবন ও সম্মানজনক-অনির্ভরশীল পেশাজীবনকেও সুনিশ্চিত করবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।

বিশেষত আমাদের জনজীবনে শিক্ষাজীবী, গবেষক, চারুশিল্পী, বিন্যাস-পরিকল্পক কিংবা পরিবেশন শিল্পীগণ স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় থাকলেও পরস্পরের পেশায় ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকেন না। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্য এমন, যাতে বিষয়গত সংযোগের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিল্পের কর্মবাস্তবতায় উপযোগিতার প্রসার ঘটাতে পারে। পাশাপাশি স্ব স্ব ক্ষেত্রের দিকপাল ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা, উপদেশ ও কার্যকর সহযোগিতা পেয়ে শিক্ষার্থীরাও নিজেদের পাঠ্যবিষয়ে গভীর ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে এবং দেশ ও বিদেশের সমসাময়িক সৃজনক্ষেত্রে উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর রাখতে পারে। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে বিদ্বান ব্যক্তিদের অঙ্গীকার ও গভীর অভিনিবেশ দ্বারা রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি সাজানো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা এবং মানবসম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক রূপান্তরের প্রত্যাশা তাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর