আগামী পাঁচ বছরের জন্য ফ্রান্সের নেতৃত্ব দেবেন কে?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 10:26:35

শনিবার (২৩ এপ্রিল) ফ্রান্স একটি তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মেরুকরণের নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করেছে এবং আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশের নেতৃত্ব বেছে নিতে অপেক্ষা করছে।

আগামী পাঁচ বছরের জন্য ফ্রান্সের নেতৃত্ব দেবেন কে? মধ্যপন্থী রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন এবং চরম ডানপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী মেরিন লে পেনের মধ্যে নির্বাচনী তীব্র লড়াইয়ের ময়দান থেকে পেতে হবে এই প্রশ্নের উত্তর। তবে, রোববার (২৪ এপ্রিল) সন্ধ্যার মধ্যে, বিশ্ব জানবে ফ্রান্স তার প্রথম মহিলা নেতা কিংবা জ্যাক শিরাকের পর প্রথম দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে কিনা।

নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলো বিবেচনায় দেখে মনে হচ্ছে ইমানুয়েল ম্যাক্রন বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন;  তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী, অতি-ডানপন্থী মেরিন লে পেনের চেয়ে ভোটে দশ-পয়েন্ট গড়ে এগিয়ে আছেন।  যে মেরিল লে এখনও ম্যাক্রোঁর সীমার মধ্যে রয়েছেন, তিনি ২০১৭ সালে ৩০ শতাংশ পয়েন্টে পরাজিত হয়েছিলেন ম্যাক্রনের কাছে।

ফ্রান্সের এই নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমা দেশের রাজধানীগুলোও নার্ভাস রয়েছে। কারণ, ফরাসিরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাকি রাশিয়ার দিকে ঘেঁষা নেতা বেছে নেয়, তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। ইইউ সদর দপ্তর ব্রাসেলসের চেয়ে মস্কোর কাছাকাছি একজনের নেতার হাতে ফ্রান্সের শাসন অদলবদল হলে সবাই চিন্তা বাড়বে।

এদিকে, নির্বাচনে সিদ্ধান্তহীন ভোটাররা একটি উদ্বেগের বিষয়। প্রায় ১১ শতাংশ ভোটার এখনও তাদের মন তৈরি করতে পারেনি। বাম প্রার্থী জিন-লুক মেলেনচনের সমর্থকরা আরেকটি  গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বস্তুত অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেরুকরণের কারণে ফ্রান্সে নির্বাচনের ফল সম্পর্কে রয়েছে টানটান উত্তেজনা। বিশেষজ্ঞরা জোর গলায় কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছেন না।

তবে, গবেষক মিশেল বারবেরো, ফরেন পলিসি জার্নালের এক লেখায় প্যারিসের একজন মেলেনচন সমর্থকের সাথে কথা  বলার। সূত্রে জানাান, সেই ভোটার রোববার ভোট দেবেন কিনা তা নিশ্চিত নন।  "আমি হতাশাগ্রস্ত। আরও সামাজিক ন্যায়বিচার আনতে রাজনীতিতে আমার আস্থা এমনিতেইনকম এবং সেটা ক্রমশ আরও দ্রুত কমছে," তিনি বলেছিলেন গবেষক মিশেল বারবেরোকে।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেনের নির্বাচন যেমন দেখিয়েছে, একজন কেন্দ্রবাদী প্রার্থীর বিজয়ের পেছনে যাদুকরীভাবে অসক্রিয় ভোটারদের আকস্মিক ও সুপ্ত মেরুকরণ কাজ করেছিল। তেমনটি ফ্রান্সে সম্পন্ন হলে ভোটের সব অংক উল্টে যাবে। ম্যাক্রনের আপাত সম্ভাবনার মধ্যেও লে পেন সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন না। কারণ, এবারই শুধু নয়, আগামী ২০২৭ সালের নির্বাচনের সময়ও মাত্র ৫৮ বছর বয়সী মেরিন লে পেন মাঠে থাকবেন আর ফ্রান্সের বিধি মোতাবেক টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে বাধা দেওয়া হবে ম্যাক্রনকে।

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইইউ পরিস্থিতি, ন্যাটোর ভবিষ্যত, এশিয়া-প্যাসিফিকে সামরিক সজ্জা এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের পটভূমিতে এই নির্বাচন শুধু ফ্রান্সের ভেতরেই নয়, সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ বৃহস্পতিবার  লা মন্ডে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা 'অপ-এড'-এ একটি স্বনামের লেখায় ম্যাক্রনের পক্ষাবলম্বন করেছেন।  স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এবং পর্তুগিজ প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও কস্তারও নিজেদের নামে প্রকাশিত লেখায় ম্যাক্রনকে সমর্থন করেছেন। ম্যাক্রনকে তারা "একজন গণতান্ত্রিক প্রার্থী, যিনি বিশ্বাস করেন যে ফ্রান্স একটি শক্তিশালী ইইউতে বেড়ে উঠছে" মর্মে অভিহিত করেছেন।

অনেকেই ম্যাক্রনের প্রতিপক্ষকে "অতি-ডানপন্থী প্রার্থী, যিনি আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে আক্রমণকারীদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে সমর্থন করেন," বলে লে পেন এবং পুতিনের মধ্যকার সম্পর্কের নানা বিপদ সম্পর্কে আভাস দিয়েছেন। ব্রাজিলের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সরাসরি ম্যাক্রনের পক্ষে নেমে ফ্রান্স "গণতন্ত্রের জন্য ভবিষ্যত ঝুঁকিতে রয়েছে" বলে বর্ণনা করেছেন এবং লে পেনকে পরাজিত করার মাধ্যমে গণতন্ত্রের রাহুমুক্তি ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রকাশ্যে তার পছন্দ প্রকাশ করেননি, তবে তার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পূর্বসূরি বারাক ওবামা ইঙ্গিতে ম্যাক্রনের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনকালেও তিনি ম্যাক্রনকে সমর্থন করেছিলেন।

নির্বাচনে লে পেন তার নিজের এবং রাশিয়ান নেতার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করলেও তাতে ফল হয় নি। দুনিয়াজোড়া লোকজন তাকে রুশপন্থী, পুতিনভক্ত বলেই জানে। তবে সুচতুর রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ফ্রান্সের নির্বাচন প্রসঙ্গে নীরব রয়েছেন। রুশ অনুগত  হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডসহ পুতিনের আদর্শিক মিত্ররাও লে পেনকে প্রকাশ্য সমর্থন জানানো থেকে বিরত থেকেছে। পাছে রুশ-বিরোধী জনমত বিগড়ে যায়, এজন্যই এমন সতর্কতা। তবে, বন্দী রুশ ভিন্নমতাবলম্বী আলেক্সি নাভালনি সুম্পষ্টভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে ম্যাক্রনের পক্ষে সরব হয়েছেন এবং তার প্রতিপক্ষকে তিরস্কার করেছেন। তিনি টুইটারে বলেছেন যে, পুতিনের প্রতি সহানুভূতিশীল যে কোনও তথাকথিত রক্ষণশীল "আসলে বিবেকহীন একজন ভণ্ড,", যা লি পেনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে।

বস্তুত, কোভিডের মহামারি আর ইউরোপের একপ্রান্তে যুদ্ধাবস্থা পশ্চিম গোলার্ধের নেতৃস্থানীয় দেশ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে দেশের ভেতরে ও বাইরে চরম উত্তেজনাকর বিষয়ে পরিণত করেছে, যে উত্তাপের অবসান হবে রোববার (২৪ এপ্রিল) সন্ধ্যায়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর