‘অক্ষম আক্রোশে’ সয়ে চলি পুনঃপুন বেত্রাঘাত!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-30 05:21:14

হাত পেতে আছেন একজন নাগরিক, দামি গাড়ির ভেতর লাঠি হাতে উদ্যত জনপ্রতিনিধি। হাতের লাঠি কিংবা বেত দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়েও দিলেন হাতে। নিরীহ নাগরিকের করার কিছুই নেই, প্রতিবাদ করারও জো নেই; হাত পাতা আছে তো আছেই, সে যত বাড়ি পড়ুক। নগরের নাগরিক পেশায় এক ভ্যানচালক, একটি কোম্পানির মালামাল সরবরাহ করেন। সামান্য বেতনের চাকুরে অথবা দৈনিক মজুরিতে কাজ করা শ্রমিক, গরিব; একজন সিটি মেয়রের তুলনায় নিরীহ তো বটেই!

দৃশ্যটা সিলেটের। শনিবার দুপুরের দিকে ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক এক ছাত্রনেতা। ছাত্র ইউনিয়ন সিলেট জেলা শাখার সাবেক সভাপতি সপ্তর্ষী দাস এই ঘটনার সচিত্র বর্ণনা দেন ফেসবুকে। এরপর এটা ভাইরাল হয়। এবং এই ভাইরাল হওয়ার কারণেই সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আত্মপক্ষ সমর্থন করে বেত্রাঘাতের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলছেন, ‘আমি ওই চালককে বেতের বাড়ি দিইনি। বেত উঁচিয়ে একটু শাসিয়েছি মাত্র। ভবিষ্যতে যেন এভাবে যান দাঁড় করিয়ে তিনি যানজট সৃষ্টি না করেন, পরে সেটি তাকে বুঝিয়ে বলেছি। অথচ বিষয়টি ভুল ব্যাখ্যা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ ছবিটি ছড়িয়ে অযথাই আমাকে বিতর্কিত করছেন।’ মেয়র বলছেন, ‘ঈদের আগে নগরে যানজট যেন না হয়, সে জন্য কয়েক দিন আগেও পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে সিটি করপোরেশন সভা করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সকাল ১০টার আগে ভ্যান–জাতীয় যানগুলোকে মালামাল ওঠানো–নামানোর কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু আজ বেলা দেড়টার দিকে ওই সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দেখেন, ওই চালক দুটি ভ্যানগাড়ি দিয়ে মালামাল ওঠানো–নামানো করছেন। এতে সড়কে যানজট দেখা দিয়েছে।’

মেয়র যতই নিজের অপরাধকে হালকা করার চেষ্টা করুন না কেন প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলছেন তাতে মেয়রের বেত্রাঘাতের ঘটনা অসত্য নয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টির উপস্থাপক সপ্তর্ষী দাস সম্পর্কে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে তার অভিযোগকে মিথ্যা ভাবতে পারছি না। সপ্তর্ষীর ভাষায়—‘একজন সিগারেট কোম্পানির কর্মচারী ভ্যান রেখে ডেলিভারি দিতে গেছে পাশের দোকানে। সেই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো মেয়রের গাড়ি, তাকে দেখে এই ভ্যানচালক ভ্যান সরিয়ে নিতে গেলে, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তাকে হাত পাততে বলেন এবং উনার হাতে থাকা লাঠি দিয়ে দুটো বাড়ি দেন।’ ‘এ শহরের অনেক রিকশাচালক ও খেটে খাওয়া মানুষের পিঠ খুঁজলে মেয়র আরিফের লাঠির আঘাতের অনেক দাগ খুঁজে পাওয়া যাবে’, অভিযোগ সাবেক এই ছাত্রনেতার।

সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সম্পর্কে বেশ ইতিবাচক দেশের মানুষ। সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মী যেখানে সরকারের কৌশলে কোণঠাসা সেখানে একমাত্র আরিফুল হক চৌধুরীই সরকারের একাধিক মন্ত্রী বিশেষ করে প্রথমে আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সহযোগিতায় সিলেটে প্রভূত উন্নয়নকার্য সম্পাদন করে যাচ্ছেন। উন্নয়ন প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে তিনি বিন্দুমাত্র অসহযোগিতা পেয়েছেন এমন অভিযোগ কেউ করতে পারবে না।

আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমানের কাছ থেকেও বিপুল সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ওই সময় তিনি মেয়র না হলেও তৎকালীন সিটি মেয়র প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমেদ কামরানকে পাশ কাটিয়ে নগর উন্নয়ন কমিটির নামে সকল কিছুর হর্তাকর্তা ছিলেন। সেই সময়ের ওয়ার্ড কমিশনার আরিফ সামনে-পিছে পুলিশ প্রহরা নিয়ে চলাফেরা করতেন। নিজস্ব বিশেষ বাহিনী ছাড়াও তার বাসায় সার্বক্ষণিক পুলিশি প্রহরাও থাকত। আরিফুল হক চৌধুরী ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে দেশের পঞ্চাশ শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে তালিকাভুক্তও হয়েছিলেন। তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার আসামিও। প্রথম দফায় সিটি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর কয়েক দফা তিনি কারাগারে থাকলেও এরপর বেরিয়ে এসে বিপুল ক্ষমতা নিয়ে সিলেটের মেয়রের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার এই ক্ষমতার মূলে যে মুহিত-মোমেন পরিবারের ঔদার্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক সহনশীলতার পরিবেশ এটা বললে অত্যুক্তি হবে না। মুহিত-পরিবারের অবদানের কথা তিনি নিজেও স্বীকার করেন, সিলেটের এই দুই গুণীকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তিনি একাধিকবার গণসংবর্ধনাও দিয়েছেন।

সিলেট ও সিলেটের বাইরের মানুষ আরিফুল হক চৌধুরীর উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা পেলেও তিনি সিলেটের নিম্ন-আয়ের মানুষদের কাছে অন্য-চরিত্রের। তিনি বিভিন্ন অভিযানে নানা সময়ে বের হলে তার হাতে থাকা লাঠি দিয়ে যে কাউকে আঘাতও করে থাকেন। বিভিন্ন অভিযানে তিনি, তার বাহিনী ও সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরা মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করে থাকেন, এমন অভিযোগ আছে। শ্রমিকদের সঙ্গে মারামারির নানা ঘটনাও আছে—এসব নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম নানা সময়ে প্রতিবেদনও হয়েছে। দুর্ব্যবহারের নানা অভিযোগ থাকলেও কখনই এভাবে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হয়নি আগে। এর কারণ মূলত ঘটনাকে সামাজিক মাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমে নিয়ে আসার মতো কেউ অকুস্থলে ছিল না, অথবা যারাই ছিল তারা হয় ভয়ে নয় মেয়রের জনপ্রিয়তায় এগুলোকে ভবিতব্য বলেই ছাড় দিয়েছে। তবে এবারের এই ঘটনা এভাবে সামাজিক মাধ্যমে আসার কারণ হতে পারে স্বভাব-প্রতিবাদী সাবেক ওই ছাত্রনেতার তাৎক্ষণিক ভার্চুয়াল প্রতিবাদ। ভার্চুয়াল এই প্রতিবাদের শক্তি এমনই যে এটা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে প্রতিবেদন হিসেবে তুলে আনার পথ দেখিয়েছে, এবং খোদ মেয়রকে আত্মপক্ষকে সমর্থন করতে বাধ্য করেছে।

মেয়র তার সাফাই-বাক্যে যানজটকে সামনে এনেছেন। যানজট নিরসনে মেয়রের যেকোনো উদ্যোগকে নাগরিক ও নগরবাসী স্বাগত জানাবে ঠিক, কিন্তু এরজন্যে কেন তাকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হবে? কেন তিনি গাড়িতে বসে বেত উঁচিয়ে ওই শ্রমিককে পেটাবেন? এই অধিকার তিনি কেন কেউই রাখেন না। তিনি মেয়র হতে পারেন, কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে ওঠা কেউ নন। বেত্রাঘাত হোক কিংবা লাঠিপেটা যাই হোক প্রচলিত আইনে এটা অপরাধ। সিটি করপোরেশনের মতো একটি দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে প্রকাশ্যে দিবালোকে আইনের এমন লঙ্ঘন আর যাই হোক ‘আইনের সকলের জন্যে সমান’ এই আপ্তবাক্যে আস্থার বিষয়টি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়!

ঘটনার পর মেয়রের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় এজন্যে অনুতাপ প্রকাশ পায়নি। তিনি বেত্রাঘাতের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। নগরে হাতে লাঠি কেন মেয়র এই প্রশ্নের জবাবে ‘লাঠি হাতে রাখা সুন্নত’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন মেয়র লাঠি কিংবা বেত হাতে নগরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, পেটাচ্ছেন, শাসিয়ে যাচ্ছেন—এরচেয়ে ভয়াবহ বিষয় আর কী হতে পারে! এটা কি আমাদের সভ্য সমাজের নমুনা? প্রশ্ন!

নগরে ‘নগরপিতা’ কর্তৃক নাগরিক নিপীড়নে আমরা সংক্ষুব্ধ। এই ঘটনার বিচার দাবি করি। সামান্য বেতনের চাকুরে অথবা দৈনিক মজুরিতে কাজ করা ওই শ্রমিক কিংবা ওর প্রতিষ্ঠান এজন্যে আইনের আশ্রয় নেবে না বলেই ধারণা করি। আইনের আশ্রয় নেওয়াকে অনেকেই ভোগান্তির পথ রচনা বলেই মনে করে এখনও, তার ওপর মেয়রের বিরুদ্ধে কোন নাগরিকের আইনের আশ্রয় নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বটেই! তাই বলে কি এই ঘটনার আইনি প্রতিবিধান হবে না? রাষ্ট্রের কি কোন দায় নেই এখানে?

অনুতাপহীন মেয়র যখন সাফাই-বাক্যে তখন সংক্ষুব্ধজন হয়ে আমরা পুড়ছি মূলত ‘অক্ষম আক্রোশে’; সয়ে চলছি পুনঃপুন বেত্রাঘাত! কতদিন এভাবে; বলবে কি রাষ্ট্র? রাষ্ট্রের তো বলা উচিত!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলামলেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর