আধুনিক বৈশ্বিক সমস্যার সর্বশেষ নাম করোনাভাইরাস

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:57:56

বিশ্ব নানা সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। এভাবেই বিশ্বসভ্যতা পেরিয়ে এসেছে নানা সঙ্কুল পথ। যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ, সংঘাত, বন্যা, মারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা বিপর্যয় ও সমস্যা। আধুনিক বৈশ্বিক সমস্যার সর্বশেষ নাম এখন করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে উত্থিত হয়ে বিশ্বকে উথালপাতাল আবহে নাকাল করছে এই মহামারির সমস্যা।

করোনাকে বিশ্বব্যাপী আধুনিক সমস্যার একটি সিরিজের মতো মনে করা হচ্ছে। যে সমস্যার গতি অচেনা। প্রকৃতি অস্পষ্ট। এবং যে সমস্যাটি আদৌ কোনও ভৌগোলিক সীমানা স্বীকার করে না।

বিশ্বায়নে ফলে বিগত দুই দশক ধরে বিশ্ব যত বেশি সংযুক্ত হচ্ছে, বিশ্বের সম্ভাবনার পাশাপাশি সমস্যাও তেমনিভাবে একাকার হয়েই বেড়েছে। আর করোনা প্রমাণ করেছে যে, একটি দেশের সমস্যা কত দ্রুত সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিশ্বে এমন ঘটনা প্রায়শ ঘটে। যেমন, একটি দেশের গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রতিক্রিয়াজনিত সমস্যা সমগ্র বিশ্বেরই জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং সমগ্র জগতকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। একইভাবে, কোনও একটি দেশের অর্থনৈতিক পতন বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারে শকওয়েভ পাঠাতে পারে। আমরা মূলত এমন একটি বিশ্বে বসবাস করছি, যেখানে কোটি কোটি মানুষ মাত্র একটি ক্লিকের দূরত্বে রয়েছে। আনন্দ, বিষাদ, সহিংসতা বিশ্বজুড়ে নিমেষেই ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে আপামর মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

আমরা এটি পছন্দ করি বা না করি, বিশ্বের দেশগুলো বর্তমানে একাকী থাকতে পারছে না এবং কোনও সমস্যা থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখতেও পারছে না। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কথাটি বিশেষভাবে সত্য, যা করোনা মহামারির বৈশ্বিক বিস্তারের মারাত্মক ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য সবারই জানা। যেমন, এই অভিনব ধরণের করোনভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের রোগ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। বিশ্বব্যাপীই দেশে দেশে অভাবনীয় মৃত্যু ও আক্রান্তের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সমাজ ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব বিপদ ঘটিয়েছে।

ফলে চলমান করোনা মহামারি সেসব দেশ ও মানুষের জন্য চরম সতর্কবার্তা, যারা বিশ্বাস করে যে, বিশ্বজুড়ে যা ঘটে তা তাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। পাশাপাশি করোনার শিক্ষা বৈশ্বিক সমস্যাগুলোকে দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ রাখার ধারণাকেও চুরমার করে দিয়েছে। করোনা এই স্বীকৃতি দেয় যে, সমস্যা যেদেশেই হোক, এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিশ্বজনীন হতে বাধ্য।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্যসব সমস্যার মতোই করোনা স্থানীয়ভাবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এটি দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে পৌঁছেছে এবং কার্যত প্রতিটি পেশাদার শিল্পকে প্রভাবিত করছে। যেমন, ভাইরাসটি সাব-সাহারান আফ্রিকায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের বাজারকে টলিয়ে দিয়েছে। মধ্য এশিয়ায় কর্তৃত্ববাদীদের ক্ষমতায়ন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাবলিক হেলথ ব্যবস্থার নতুন বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকায় ক্ষুদ্র পুঁজি ও কর্মসংস্থানকে বিরাট ঝাঁকি দিয়েছে। নানা দেশের সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে প্রতিদিনই দৌড়াতে বাধ্য করেছে। এবং সর্বপরি, বিশ্বকে বৈশ্বিক সমস্যার স্থানীয় আর্থ-সামাজিক, জনস্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে।

করোনার কারণে এখন সবার কাছে এমনও মনে হতে পারে যে, পৃথিবী আগে এত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়নি। এবং সত্যিই একটি সমস্যার গর্ভ থেকে এতোগুলো অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হয় নি। বিশ্বকে বর্তমানে অজানা জলের মধ্য দিয়ে পথ তৈরি করতে হচ্ছে। এতো অনিশ্চয়তার মুখোমুখি বিশ্ব আগে কখনওই হয় নি।

যদিও করোনার কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো বিশাল, জটিল এবং বৈচিত্র্যময়, তথাপি সেগুলো এককভাবে কারো নিজস্ব সমস্যা নয়, সারা বিশ্বেরই সঙ্কট। করোনা বিশ্বের প্রচলিত সমস্যার গতি, প্রকৃতি, ধরণ এবং মাত্রা সম্পর্কেও নতুনভাবে ভাবনার অবকাশ দিয়েছে। বিশ্ব সম্পর্কে বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞরা চলমান বিশ্বদর্শনগুলোকেও নতুনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। কারণ, কখন কোন সমস্যা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্থায়ী সমস্যাগুলোকে ভেঙে দেয় এবং নতুন বিপদের সূচনা করে, তার ব্যাপারের সার্বক্ষণিক সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানের সঙ্গে অনাগত সমস্যা সম্পর্কে আগাম সতর্কতার ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং বিনিয়োগের মৌলিক সম্পর্ক রচনা করার ইস্যু বর্তমানে অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সবাইকে জানাতে হবে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আপদ-বিপদ সম্পর্কেও।

বস্তুত, করোনা অনেক উপায়ে বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে। তথ্য এবং জ্ঞান অন্বেষণের দ্বারা আধুনিক বৈশ্বিক সমস্যার সর্বশেষ নাম করোনাভাইরাসের আদ্যোপান্ত সম্পর্কে জানলেই চলবে না, বরং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও ওয়াকিবহাল হতে হবে। এবং অবশ্যই বিশ্বের বিপদগুলোকে স্থায়ী, অনড়, অচল ও অপরিবর্তনীয় ধরে বসে থাকলেও চলবে না। সব সময়ই নানাদিক ও নানাস্থান থেকে আগত সম্ভাব্য বিপদের আগাম বার্তা সম্পর্কেও পূর্বাভাস তৈরি করে রাখতে হবে। বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তি ও গবেষণাকে কেবল অতীত অন্বেষী বা বর্তমানমুখী হওয়ার বদলের ভবিষ্যতের দিকে শ্যেন দৃষ্টি রেখেই চলতে হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর