বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তার চেয়ে কত পেছনে বাংলাদেশ?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 02:56:04

রেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক যে রাস্তায় বছরে প্রাণ যায় ৩০০ মানুষের, তারচেয়ে কতদূর পেছনে বাংলাদেশের রাস্তাগুলো? নাকি সন্তর্পণে বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড গড়েছে মরণআঘাত করার জন্য কুখ্যাত বাংলাদেশের রাস্তাগুলো?

ঈদে, উৎসবে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের সড়কগুলোকে বলা হয় মরণফাঁদ। একদা আরিচা সড়ক ছিল দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে শীর্ষে। তারপর ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং বর্তমানে যেকোনও জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু নিত্যনৈমিত্তিক স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

রেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক যে রাস্তায় বছরে প্রাণ যায় ৩০০ মানুষের, সেটি একটি ভয়াবহরূপে সঙ্কুট পার্বত্যভূমিতে নির্মিত সড়ক। বাংলাদেশ সমতলের দেশ, সড়কগুলো বিপজ্জনক নয়। কিন্তু নিয়মহীনতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা, চালকদের হিংসাত্মক মানসিকতা এবং উগ্র প্রতিযোগিতাসহ নানাবিধ দুষ্কর্মের কারণে বাংলাদেশের সড়কগুলো বিপদসঙ্কুল মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত সড়কে রক্ত ঝরছে। প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আহত ও পঙ্গু হচ্ছে সংখ্যাতীত নারী ও পুরুষ।

বাংলাদেশের সড়কে মৃত্যুর ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় ঈদে, উৎসবে। প্রচণ্ড ভীড় ও যানজটের মধ্যেও ধৈর্যের বদলে উন্মাদ-তুল্য আচরণ করে সংশ্লিষ্টরা। বেশি টাকা ও বেশি ট্রিপ পেতে উগ্র প্রতিযোগির ফলে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনার। বৃদ্ধি পায় আহত-নিহতের সংখ্যা।

অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা মতো নয় আমাদের রাস্তাগুলো। আন্দিজ পর্বতমালার গা বেয়ে উপরে উঠে গেছে আঁকাবাঁকা সেই রাস্তা। কোথাও কোথাও তার প্রস্থ মাত্র ফুট দশেক। রাস্তার ধারে নেই কোনো ব্যারিকেড কিংবা সেফটি পিলারও। একবার নিয়ন্ত্রণ হারালে, গ্রাস করে নেবে কয়েকশো ফুট গভীর খাদ। সেইসঙ্গে এই দুর্গম পথের দোসর গভীর আমাজন অরণ্য। ফলে, হিংস্র জীবজন্তুর ভয় তো রয়েছেই। এমন জায়গা অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীদের কাছে আক্ষরিক অর্থে ভূস্বর্গ হলেও নিরাপত্তার দিক থেকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ ও মারাত্মক বিপজ্জনক।

বলিভিয়ার আন্দিয়ান শহর লা পাজ থেকে উত্তরের করোইকো গ্রাম— এই দুই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র সংযোগই হল এই ভয়াবহ পথ। যাকে ঘাতক বললেও ভুল হয় না এতটুকু। বলিভিয়ার এই কুখ্যাত রাস্তা পরিচিত ‘ক্যামিনো দে লা মুয়েরতে’ নামে। যে স্পেনীয় কথার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘মৃত্যুর পথ’ (Death Road)।

বস্তুত, এই রাস্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জুড়ে রয়েছে প্রাণহানির গল্প। ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তা প্রতিবছর প্রাণ কেড়ে নেয় প্রায় ২০০-৩০০ জন মানুষের। পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। রাস্তার ধারে খাদে ছড়িয়ে রয়েছে বাস, ট্যাক্সি, লরি-সহ অসংখ্য মোটরগাড়ি। সংকীর্ণ রাস্তা, ১৮০ ডিগ্রি তীক্ষ্ণ বাঁক যেমন এইসকল দুর্ঘটনার কারণ, ঠিক তেমনই এই অঞ্চলে নিষ্ঠুর প্রকৃতিও। বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় এই রাস্তাটি সারাবছরই ঢাকা থাকে গভীর কুয়াশায়। শীতকালে গাড়ি চালকদের ক্ষেত্রে তাই আরও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে এই পথের গতিপ্রকৃতি। পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই ধ্বস নামে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে।

তবে শুধু ঘাতক চরিত্রই নয়, জন্মলগ্ন থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক এই ‘ডেথ রোড’-এর। শুরুটা প্রায় ৯০ বছর আগে। ১৯৩২ সালে। তখন দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হয়েছিল বলিভিয়া। মারা গিয়েছিলেন ব্রাজিল এবং প্যারাগুয়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সেই রক্তক্ষয়ী ‘চাকো’ যুদ্ধের সময়ই তৈরি হয়েছিল এই রাস্তা। তৈরি করেছিলেন প্যারাগুয়ের জেলবন্দিরা। পালানো এবং গা ঢাকা দেওয়ার জন্য গভীর আমাজন এবং দুর্গম পার্বত্য উপত্যকায় সংকীর্ণ পথকেই বেছে নিয়েছিলেন তারা। তা সত্ত্বেও সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছিল বহু কারাবন্দির।

পরবর্তীতে এই রাস্তার প্রস্থ বৃদ্ধি করার চেষ্টা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। আন্দিজের এই অঞ্চলে ভঙ্গুর ভূপ্রকৃতিই তার অন্যতম কারণ। অথচ, ততদিনে পাহার চূড়ায় গড়ে উঠেছে করোইকা গ্রাম। কাজেই এই বিপদসঙ্কুল পথই হয়ে ওঠে গ্রামবাসীদের একমাত্র আস্থা। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাদের ব্যবহার করতে হয় এই পথ। আবার এই পথেই রাজত্ব চলে ড্রাগ মাফিয়া কিংবা লগারদের বা মানব ও অস্ত্র পাচারকারীদের। কখনও পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার প্রয়োজনে দুর্গম পথকে বেছে নেওয়া হয়।

জীবনের আর্থিক সুখ ও সুবিধা পাওয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক, দুর্ঘটনাপ্রবণ, পার্বত্য 'মৃত্যুর পথ’ (Death Road) পাড়ি দেয় দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ। কিন্তু সমতল বাংলাদেশের আপাত নিরাপদ রাস্তাগুলো পাড়ি দিয়ে মানুষ 'মৃত্যুর পথ’-এর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বাধ্য হচ্ছে। এমন মারাত্মক প্রবণতা চলতে থাকলে হয়ত অচীরেই বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড গড়বে মরণআঘাত করার জন্য কুখ্যাত বাংলাদেশের রাস্তাগুলো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর