কোটিপতি হওয়ার সহজ উপায়, বিফলে মূল্য ফেরৎ!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-09-01 21:24:12

আপনি একজন ব্যবসায়ী, কিন্তু আরও বড়লোক হতে চান? কোটিপতি হতে চান? ক্ষমতা চান? মন্ত্রী হতে চান? কাড়ি কাড়ি টাকা বানাতে চান? অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের নিরাপত্তা চান? দুদকের হাত থেকে বাঁচতে চান? পুলিশ-চাঁদাবাজ আরও নানা সরকারি-বেসরকারি ঝামেলাবাজের হাত থেকে রেহাই পেতে চান? এসব কিছুই সম্ভব যদি আপনি একবার সরকারি দলের এমপি হতে পারেন।

একজন ব্যবসায়ীকে একটি ব্যবসা দাঁড় করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তিল তিল করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়। কত রকম ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু একবার এমপি হলে সব কিছু জলের মতো সহজ হয়ে যাবে। আর এমপি হওয়াটাও খুব কষ্ট সাধ্য নয়। দরকার আন্তরিক ইচ্ছে, আর কার্যকর পরিকল্পনা।

আপনি ১০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট নিন। মনোনয়ন পেতে আপনি খরচ করবেন ৫০ কোটি টাকা। মনোনয়ন নিশ্চিত হবার পর আপনি থানা, পুলিশ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের জন্য রাখলেন ১০ কোটি। বাকি ৪০ কোটি টাকা ওড়ালেন নির্বাচনী এলাকায়। এলাকার সমস্ত মসজিদ-মক্তব-মাদ্রাসা-মন্দিরে গিয়ে আপনি নগদ কিছু অনুদান দিন। কিছু বাছাই করা গরিব-দুঃখীকে শাড়ি-লুঙ্গি দিন। এলাকার টাউট-বাটপার-ধান্দাবাজগুলোকে আলাদা আলাদা বাসায় ডেকে নিয়ে একটু পোলাও-মাংস খাওয়ান। এরপর নগদ কিছু ধরিয়ে দিন। ভবিষ্যতে আরও কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিন। টাকা পেলে খেটে-খাওয়া আর চেটে-খাওয়া উভয় ধরনের মানুষই আপনার পক্ষে কথা বলবে। এভাবে যদি ঠিকঠাক মতো টাকা ছিটাতে পারেন, তাহলে আপনার বিজয় নিশ্চিত।

নির্বাচনে জয়ী হবার পর আপনাকে মনোনিবেশ করতে হবে টাকা ওঠানোর খেলায়। ডিউটি ফ্রি গাড়ি দিয়ে শুরু করুন। গাড়ি বেঁচে পাবেন অন্তত এক কোটি। এরপর শুরু করুন চাকরির সুপারিশ। মনে রাখবেন, চাকরির বাজারে চরম আকালের দিনে এমপিদের সুপারিশ যেন দুর্ভিক্ষে লঙ্গরখানা। কাজেই সুপারিশ শুরু করুন। সব কিছু ঠিকঠাক মতো করার জন্য সিস্টেম চালু করুন। মনে রাখবেন, চাকরির জন্য মিছিল আসবে। আপনি বিশ্বস্ত লোক ঠিক করুন যে আপনার হয়ে নগদ গুনে নেবে। তাকেও নজরদারিতে রাখুন। দুয়েকজন চামচা গোছের ব্যক্তিকে গোয়েন্দা হিসেবে লাগিয়ে রাখুন। তবে তাদের পেমেন্টে নিয়ে কোনো ঝামেলা করবেন না। প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে ডেকে বলুন, সে-ই আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ। স্ত্রী-সন্তানও তার মতো বিশ্বস্ত নয়। বিভিন্ন পদের চাকরির জন্য আলাদা আলাদা রেট ঠিক করুন। চাকরির বাজারে নানা পদের চাকরির সুপারিশ আসবে। পুলিশের কনস্টেবল থেকে বিসিএস অফিসার। কৃষি থেকে সমবায়, প্রাথমিক শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পৌরসভার ঝাড়ুদার থেকে সচিবালয়ের পিয়ন। আপনাকে সব ধরনের চাকরির জন্যই তদবির করতে হবে। প্যাডের মধ্যে ডিও দিন। চাকরি হোক না হোক পরের কথা। তবে টেলিফোনে কিছু লোকের সঙ্গে খায়খাতির লাগানোর চেষ্টা করুন। সব সুপারিশই যেন ব্যর্থ না হয়। মানুষ তাহলে অবিশ্বাস করবে।

তবে কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যারা টাকা দেন তারা গোপনেই দেন। কিন্তু গোপন কথাটি সব সময় গোপন থাকে না। আপনার লোক একটি চাকরির জন্য চাইলেন ১০ লাখ টাকা। চাকরি-প্রার্থীর বাবা দরিদ্র কৃষক। তার কাছে নগদ ১০ লাখ টাকা নেই। পাড়া-পড়শীদের নিয়ে বাড়ির উঠোনে বৈঠক করলেন। এমপি সাহেব চাকরি দেবেন। ১০ লাখ টাকা লাগবে। রাতভর বৈঠক করে কৃষক বেচারা সিদ্ধান্ত নিলেন, তার সম্বল জমি বিক্রি করবেন। জমি বিক্রিতে পেলেন ৬ লাখ। চার লাখ টাকা নিতে গেলেন সুদে। সুদের বাজার চড়া। সুদদাতা বললেন, এতো টাকা কেন, কৃষক জানালেন এমপি সাহেবকে টাকা দিতে হবে। চড়া সুদে টাকা নিয়ে কৃষক বাড়িতে আবার বৈঠক ডাকলেন। সব বুদ্ধি পরামর্শ শেষে গেলেন এমপি সাহেবের বাসায়। এমপি সাহেব ব্যস্ত। টাকা নিয়ে কৃষক অপেক্ষা করছেন। এক সময় ঘর খালি হলো, এমপি সাহেব তাকে ডেকে নিলেন। তিনি সরাসরি টাকা তুলে দিলেন এমপি সাহেবের হাতে! এ রকম ঘটনা যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি পুরো গ্রাম জেনে যায় যে, চাকরি দেবার নাম করে এমপি সাহেব ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন, তাহলে কিন্তু সমস্যা হতে পারে। কাজেই এসব ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করুন।

আপনার বাসায় বিভিন্ন ধরনের কামড়া বানান। নিয়োগসংক্রান্ত কাজের জন্য একটা। উন্নয়নসংক্রান্ত কাজের জন্য আরেকটা কামড়া বানান। উন্নয়নসংক্রান্ত কাজে রয়েছে সীমাহীন টাকা। রাস্তা নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ, হাসপাতাল নির্মাণ। ঠিকাদাররা আপনার বাসায় আসবেন। আগেকার দিন হলে তারা ফল, মিষ্টি. মাছ, মুরগী, সবজি নিয়ে যেত। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে টাকাই সবচেয়ে বড় উপহার। টেন্ডার নিয়ে আলোচনা হবে, ভাগবাটোয়ারা চূড়ান্ত হবে। এরপর আপনি ডিসি, কিংবা ইউএনও, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সিভিল সার্জনকে বলে দেবেন। কোনো কোনো ঘাড়ত্যাড়া সরকারি কর্মকর্তা আপনার কথা নাও শুনতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই একজন দুইজন মন্ত্রীর সঙ্গে খাতির তৈরি করতে হবে। ডিসি, টিএনও, কিংবা ইঞ্জনিয়ারদের সামনে সেই মন্ত্রীর সঙ্গে উচ্চস্বরে রসিকতাপূর্ণ আলাপ করে বুছিয়ে দিতে হবে যে, আপনি অতটা ফেলনা নন। মন্ত্রীরা পর্যন্ত আপনার ইয়ার দোস্ত। এটা যদি আপনি বোঝাতে পারেন, তাহলে সরকারি কর্মকর্তারা বাপ-বাপ করে আপনার সব পরামর্শ মেনে নেবে।

এরপর আছে মামলা- মোকাদ্দোমার তদবির। আর বেতনের মতো আসবে টিআর, কাবিখা। বন্যা, দুর্যোগ হলেতো কথাই নেই। টাকা আসতে থাকবে বাতাসের মতো। বানের পানির মতো।

আর শুধু এক্সট্রা ইনকাম নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। নিজে আরও ব্যবসা দাঁড় করান। সরকার ক্ষমতায় তাই বানিয়ে ফেলেন হোটেল, কিংবা হাসপাতাল অথবা শপিং কমপ্লেক্স। এমপি হলে অনেক সুবিধা, অনুমতি নেওয়ার বালাই নেই। ঠিকাদারি ব্যবসাও শুরু করতে পারেন। ঠিকাদারিতে লাভ অনেক। ক্ষমতা দেখিয়ে কাজ নিয়ে কাজ বেঁচে দেওয়া। ব্যস। বছর ঘুরতেই নির্বাচনের খরচ উঠে আসবে। এরপর শুধু লাভ আর লাভ।

আপনি যদি কামেল ব্যক্তি হন, যদি লাইনঘাট ভালো থাকে, তাহলে অবশ্য চাকরির তদবির করার দরকার নেই, স্থানীয় টেন্ডারে নাক গলানোর দরকার হবে না, এমনকি টিআর, কাবিখার চাল-গম নিয়ে হাতও নোংরা করতে হবে না। মেগা প্রজেক্টে ভাগ বসান। রাজউকের বড় প্রজেক্ট নেন, বিদ্যুৎ প্রকল্প নেন, ব্যাংকের মালিক হন, সরকারি বড় কেনাকাটা বাগিয়ে নেন। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। বাজেটও আকারে বড় হচ্ছে। তাই হাজার কোটি টাকার একটা প্রজেক্ট হলেই হলো। একদানে ছক্কা।

অনেকে বলতে পারেন, রাজনীতির এই বাণিজ্যে খেলোয়াড় কজন? এমপি হন মোটে ৩০০ জন। সবাই তো আর এমপি হতে পারবেন না। বাকিদের কী হবে? তাদেরও নিরাশ হবার কিছু নেই। আপনি ছাত্র হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের পাতি-আধাপাতি নেতা হলেও টুকটাক চাঁদাবাজি করতে পারবেন। কিছু কিছু টেন্ডারে ভাড়াটে হবার কাজ পাবেন। যুব সংগঠন করলে আপনার পসার আর একটু বাড়বে। আর মূল সংগঠন করলে তো কথাই নেই। আপনি এমপির তল্পিবাহক হতে পারেন। স্রেফ ব্রোকার হয়েও আপনার আয় ভালোই হবে। অনেক ব্যবসায়ী, শিল্পপতির চেয়েও আপনি ভালো থাকবেন যদি আপনি ছোট-খাট নেতা হন। আর এখন তো তৃণমূল পর্যন্ত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন কোথাও নির্বাচিত হলেই আপনার কাছে চলে আসবে আলাদিনের চেরাগ। আর না হলেও, আপনি যদি একটু হাঁক-ডাক দিতে পারেন, দুচারজনকে গুম বা মার্ডার করতে বা করাতে পারেন, তাহলেও আপনার কাছে টাকা আসবে অঝোর ধারার বৃষ্টির মতো।

কিন্তু আপনি যদি আদর্শবান হন, ত্যাগী কর্মী হন, আপনি যদি রাজনীতি করতে চান দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, দেশ ও জাতির কল্যাণ করতে, তাহলে দুঃখিত। এখন আপনার সময় নয়। আপনাকে এক বুক কষ্ট নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে ততোদিন পর্যন্ত যখন রাজনীতি আর বাণিজ্য থাকবে না। কিন্তু সে সময় কখন আসবে, আদৌ আসবে কি না, সেটা বলা যাচ্ছে না।

কাজেই আর দেরি নয়, কোটিপতি হওয়ার চেষ্টায় নেমে পড়ুন। বিফলে মূল্য ফেরৎ!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর