দেশকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্ত করতে কার্যকর প্রচেষ্টা দরকার

, যুক্তিতর্ক

মো. বজলুর রশীদ | 2023-08-31 12:54:33

দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে। ভিক্ষুকের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য কোনো আপ-টু-ডেট জরিপ নেই। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, কোভিড-১৯-এর সময়ে গত দুই বছরে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ ভিক্ষুক হয়েছেন। দেশে সরকারিভাবে ভিক্ষুকের সংখ্যা আড়াই লাখ। অন্য কথায়, মোট জনসংখ্যার ০.১৭ শতাংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে প্রকৃত সংখ্যা ২ মিলিয়নেরও বেশি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৫০ হাজারের বেশি পেশাদার ভিক্ষুক রয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তির মত সামাজিক ব্যাধি দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে।

এবারের ঈদে রাজধানীতে বেড়েছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, চায়ের দোকান, যানজটপূর্ণ রাস্তা ও ট্রাফিক সিগন্যাল, মসজিদ, বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনাল, এটিএম বুথ ও শপিংমলের সামনে হাজার হাজার ভিক্ষুককে ভিক্ষা করতে দেখা গেছে। চার-পাঁচজন ভিক্ষুক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে। এটি অতীতের চেয়ে অনেক বেশি।

ভিক্ষার মূল পুঁজি সহানুভূতি ও ধর্মীয় অনুভূতি। তবে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ভিক্ষা করা নিষিদ্ধ। ধর্মও ভিক্ষা করাকে ঘৃণিত পেশা হিসেবে দেখে। এরপরও অনেক সময় অসহায়, দুর্বল, দরিদ্র ও পঙ্গুরা অপছন্দ সত্ত্বে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। অপমান সত্ত্বেও পুনর্বাসন ও সুরক্ষার অভাবে তারা ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়। অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে যোগ দেয়। ক্ষুধা মেটাতে তারা শহরের রাস্তায় ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়।

কয়েক দশক ধরে রাজধানী ঢাকায় পেশাদার ভিক্ষাবৃত্তি চক্র গড়ে উঠেছে। অনেকে একে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। রাজধানীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। রাস্তা-ঘাট ভিক্ষুকদের সংখ্যায় ভরে গেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী , রাজধানীতে ভিক্ষা করে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা আয় হয়। এই ভিক্ষার টাকার পরিমাণ প্রতি মাসে ৬০০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংগঠিত ভিক্ষুক চক্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য এবং এলাকার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে এই ভিক্ষা বাণিজ্য বাণিজ্য চালায়। ফলে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা।

রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে। তবে রাজধানীতে তাদের সংখ্যা এত বেশি যে তাদের মুখোমুখি হতে অনেক নাগরিকই বিব্রতবোধ করেন। কারণ এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই অসহায় মানুষকে সাহায্য করা তাদের অনেকের পক্ষেই সবসময় সম্ভব হয় না। ফলস্বরূপ, অনেকে এই ক্ষেত্রে মানসিক অসন্তোষ বা অস্থিরতা অনুভব করেন।

দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং ভিক্ষাবৃত্তির মতো অসাধু পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রতিরোধ করার জন্য, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ২০১০ সালের আগস্টে এই কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১০ সালে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন শুরু হলেও তা ব্যাপক আকার ধারণ করেনি।

ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। বরাদ্দ বাড়ায় ভিক্ষুকের সংখ্যা কম হওয়ার বদলে তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ভিক্ষাবৃত্তির মতো সামাজিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে তাদের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। জাতি হিমসবে আমাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য এগুলো বন্ধ করতে হবে। তা না হলে দেশের উন্নয়ন হয়েছে বলে যে দাবি করা হয় তা সমর্থনযোগ্য হবে না। দেশে যে উন্নয়নের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। লাখ লাখ মানুষের হাত পেতে ভিক্ষা করা প্রমাণ করে যে উন্নয়নের সুফল এখনও এই দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছায়নি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। এদেশে ধনীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। অথচ সে দেশের শহর-বন্দর-গ্রামেও অগণিত ভিক্ষুক দেখা যাচ্ছে! এ থেকে সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাব বোঝা সহজ। দিনে দিনে ধনী আরো ধনী হচ্ছে আর গরীব আরো গরীব হচ্ছে। সুতরাং, আমাদের এই ব্যবস্থার অবসানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

যদিও বর্তমানে একদল স্বার্থপর লোকের অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে পেশাদারী ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। তবে এ ধরনের জঘন্য পেশা রোধে এসব লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়। আর সেজন্য সরকারসহ সমাজের সকল স্তর থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, এনজিও, সমাজের বিত্তবানসহ সকলকে এ ব্যাপারে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি চালু করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকার ভিক্ষুকদের তালিকা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে। দেশ ও জাতিকে ভিক্ষাবৃত্তির মত জঘন্য পেশা থেকে মুক্ত করতে সরকারকেই এব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি কোনো স্বীকৃত পেশা নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। সুতরাং,ভিক্ষাবৃত্তির লজ্জা থেকে দেশকে মুক্ত করার সময় এসেছে।

মো. বজলুর রশীদ, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর